
ছবি: সংগৃহীত
৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্তকে ঘিরে দেশজুড়ে সৃষ্টি হওয়া তীব্র বিতর্ক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে অবশেষে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের রাজনৈতিক মহল, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত তরুণদের পক্ষ থেকে একযোগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসায় সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ এক বৈঠকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
রোববার (২৯ জুন) দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—৮ আগস্ট কোনো বিশেষ দিবস হিসেবে পালিত হবে না। পরিবর্তে ৫ আগস্টকে ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হবে।
বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি এ-সংক্রান্ত একটি পোস্ট দিয়েছেন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে।
সেখানে তিনি লিখেছেন, “আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ পালন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরিবর্তে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান দিবস এবং ১৬ জুলাই জুলাই শহীদ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হবে।”
প্রসঙ্গত, এর আগে গত বুধবার (২৫ জুন) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এক পরিপত্রে ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ এবং ১৬ জুলাইকে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেই পরিপত্রে বলা হয়েছিল, দিবস দুটি ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত জাতীয় দিবস হিসেবে গণ্য হবে এবং সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সরকারি সংস্থাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিন্তু এই ঘোষণার পরপরই রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজ চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণাকে ‘ইতিহাস বিকৃতি’, ‘বিরোধী মত দমনকারী সরকারগুলোর কায়দায় রাজনীতি’ এবং ‘জনগণের আন্দোলনের প্রকৃত দিন পালনে গড়িমসি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সমালোচকদের যুক্তি ছিল, দেশের ইতিহাসে ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট দিনটি ছিল প্রকৃত অর্থে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গঠিত গণআন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যের দিন, যেদিন হাসিনা সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। অথচ সেই দিনটি পাশ কাটিয়ে ৮ আগস্টকে দিবস ঘোষণার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন।
বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এই ঘোষণার কড়া সমালোচনা করে। তারা একে “জনগণের বিজয়কে দলীয় করণের অপচেষ্টা” হিসেবে বর্ণনা করে এবং ৮ আগস্ট দিবস পালন প্রত্যাহারের দাবি তোলে।
পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই রোববারের বৈঠকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ বাতিলের ঘোষণা আসে।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে এক বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ, যাঁর আত্মদানের পর থেকেই আন্দোলন নতুন গতি পায় এবং শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। তাই সরকার এখন ১৬ জুলাই দিনটিকে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্তও বহাল রেখেছে।
বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদরা এই পরিবর্তনকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব রউফ বলেন, “৫ আগস্টই ছিল জনগণের অভ্যুত্থানের দিন। সেটা পালিত না হয়ে ৮ আগস্টকে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল অগ্রহণযোগ্য। সরকারের এই সৎ সাহসকে সাধুবাদ জানাতে হয়।”
ছাত্রসংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, “সরকার জনমতকে গুরুত্ব দিয়েছে, এটাই প্রমাণ করে এখনকার প্রশাসন স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীলভাবে ইতিহাসকে মূল্যায়ন করছে।”
তবে কিছু সমালোচক মনে করছেন, এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের নীতিগত দুর্বলতা ও পরামর্শদাতাদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবও রয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, এই সিদ্ধান্ত বাতিল দেশের ইতিহাস, গণতন্ত্র ও জনমতের প্রতি সরকারের সম্মান প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির। এখন ৫ আগস্ট ও ১৬ জুলাই যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হলে তা জনসচেতনতা ও ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ