
ছবি: সংগৃহীত
গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নাটকীয় মোড় নেয়। ছাত্র-জনতার টানা আন্দোলন ও ব্যাপক গণজাগরণের মুখে দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সেদিন পদত্যাগে বাধ্য হয়। সেই ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
রোববার (২৯ জুন) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর ৫ আগস্ট ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হবে। একইসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস—১৬ জুলাই—কে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লেখেন, “আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ৫ আগস্ট দিনটিকে ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। ওই দিন ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন পথচলার সুযোগ পায়।”
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে ছাত্র-জনতার এক বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ নামের এক ছাত্রনেতা। তার মৃত্যুই দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামে নতুন মাত্রা যোগ করে এবং ব্যাপক গণআন্দোলনের জোয়ার তৈরি করে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। সেই আবু সাঈদকে স্মরণ করে ১৬ জুলাইকে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার।
তবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আগের এক সরকারি ঘোষণাও বাতিল করা হয়েছে। ২৫ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক পরিপত্রে ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ এবং ১৬ জুলাইকে ‘শহীদ আবু সাঈদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই পরিপত্রে উল্লিখিত দিবসগুলো ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত জাতীয় দিবস হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয় এবং সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে তা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
তবে রোববারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ নামের বিতর্কিত ঘোষণা প্রত্যাহার করে ৫ আগস্টকে ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো এবং ১৬ জুলাইকে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়, ৮ আগস্ট কোনো বিশেষ কর্মসূচি পালন করা হবে না। প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “৮ আগস্ট নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সেটিকে বাতিল করে আমরা প্রকৃত ইতিহাসভিত্তিক দিনগুলোকে মর্যাদা দিতে চাই। জনগণের চোখে যে দিনগুলো স্মরণীয় হয়ে আছে, সেগুলোই আমাদের জাতীয় চেতনার অংশ হওয়া উচিত।”
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে ৫ আগস্ট ‘গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ ও ১৬ জুলাই ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আগামী মন্ত্রিসভা বৈঠকে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ আগস্টকে গণ-অভ্যুত্থান দিবস ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের অংশগ্রহণমূলক আন্দোলনকে মর্যাদা দিতে চাচ্ছে। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার শাসনামলকে একটি ‘স্বৈরাচারী সময়’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টাও এর মধ্যে রয়েছে।
ছাত্রসংগঠনগুলো, বিশেষ করে আন্দোলনকালে সক্রিয় ভূমিকা রাখা ছাত্র জোট, প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য ও স্বাধীনতা ছাত্রমঞ্চ ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা ৫ আগস্টে গণমিছিল ও স্মরণসভা আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে পরিবার ও সহযোদ্ধারা আবু সাঈদকে ‘গণতন্ত্রের শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, “আবু সাঈদের রক্তের বিনিময়েই আজ বাংলাদেশ নতুন এক অধ্যায়ের মুখোমুখি হয়েছে। তাঁর স্মৃতি জাতি চিরদিন স্মরণে রাখবে।”
সার্বিকভাবে বলা যায়, এই সিদ্ধান্তগুলো একদিকে যেমন অতীতের ঘটনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করছে, তেমনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি নির্মাণেও একটি প্রতীকী উদ্যোগ হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ