
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য গঠনের পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। আগামী জুলাই মাসের মধ্যেই দেশের জন্য একটি জাতীয় সনদ প্রণয়ন সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে মঙ্গলবার (১৭ জুন) সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে আয়োজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
এটি মূলত চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া জাতীয় ঐকমত্য প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়, যেখানে পূর্ববর্তী সংলাপের অসমাপ্ত আলোচনা সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এদিনের সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বাকি ২৯টি দল ও জোটের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, “জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন সংকল্পবদ্ধ যে আমরা জুলাই মাসের মধ্যেই জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারব। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সময়, ধৈর্য ও সহযোগিতার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
তিনি জানান, কমিশন এই প্রক্রিয়াকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিতে চায় এবং অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক মতানৈক্য থাকা স্বাভাবিক হলেও সর্বসম্মতির ভিত্তিতে একটি যৌক্তিক রূপরেখা তৈরি করা সম্ভব বলে মনে করছে।
আলী রীয়াজ আরও বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি, সব বিষয়েই যেন একমত না হতে পারলেও জাতি ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে সবাই খানিকটা ছাড় দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থানে আসতে পারি। সব বিষয়ের সমাধান হয়তো সম্ভব হবে না, কিন্তু মূল রূপরেখা ও ভিত্তিপ্রস্তর নির্ধারণ করে সামনে এগোনো সম্ভব।”
কমিশনের এই বৈঠকে আলোচনার জন্য যে বিষয়গুলো নির্ধারিত ছিল, তার মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটির সভাপতির মনোনয়ন পদ্ধতি, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, এবং দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব। এ ছাড়া, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এই দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ চলবে তিন দিনব্যাপী—১৭, ১৮ এবং ১৯ জুন। প্রতিদিনই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আলোচনায় অংশ নেবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকরা। প্রত্যেকটি আলোচনার দিন ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে মনোযোগ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মতবিনিময় চলবে।
বৈঠকে আলী রীয়াজের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, আইনজীবী মুয়ীদ চৌধুরী, গবেষক সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
উল্লেখ্য, প্রথম দফার সংলাপ ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ১৯ মে পর্যন্ত চলে। এ সময়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন, নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার মতো বহু প্রতীক্ষিত পরিবর্তনের একটি কাঠামোগত ভিত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে এই জাতীয় সনদকে। সংশ্লিষ্টদের মতে, যদি আগামী জুলাই মাসের মধ্যে এটি প্রস্তুত হয় এবং তা গ্রহণযোগ্য হয়—তবে বাংলাদেশ নতুন এক গণতান্ত্রিক অধ্যায়ে প্রবেশ করবে।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের এ সংলাপ এবং সনদ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকলেও পরোক্ষভাবে তাদের স্বার্থ ও মতামতকে বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে বলে জানিয়েছে কমিশন সূত্র।
আলী রীয়াজের নেতৃত্বে দ্বিতীয় পর্যায়ের এই সংলাপ জাতীয় জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে ইতোমধ্যেই বিবেচিত হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে এই জাতীয় সনদ কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা, কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার ওপর। তবে জুলাইয়ের মধ্যেই একটি খসড়া সনদ প্রস্তুতের আশাবাদ জনমনে নতুন করে প্রত্যাশা জাগিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ