
ছবি: সংগৃহীত
পঞ্চম দিনে গড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল পরিস্থিতি—ইসরায়েল ও ইরানের পাল্টাপাল্টি সামরিক অভিযানে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে অঞ্চলটি, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংঘাত যদি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেয়, তবে বিশ্ববাসীকে তেলের চড়া মূল্য, পুঁজিবাজারের ধস এবং খাদ্যসহ মৌলিক পণ্যের দাম বৃদ্ধির মতো বহুমুখী সংকটের মুখোমুখি হতে হবে।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী এই অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই দেখা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা। একদিকে ইরানের দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে ও পরমাণু স্থাপনায় হামলার খবর, অন্যদিকে হরমুজ প্রণালি ঘিরে জাহাজ চলাচলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ—এই দুইয়ের মিলিত প্রভাব বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে তুলেছে।
শনিবার দিনভর ইসরায়েলি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের অন্তত ২২০ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে তেহরান। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ইরানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী, নারী ও শিশু। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, পারমাণবিক স্থাপনা ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে সরাসরি আঘাত হানা হয়েছে। এর জবাবে ইরানও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়, যা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বলয় ভেদ করে কমপক্ষে ২৪ জনকে প্রাণ হারাতে বাধ্য করে।
এই পাল্টাপাল্টি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের শঙ্কা চরমে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর 'ট্রুথ সোশ্যাল' প্ল্যাটফর্মে এক পোস্টে তেহরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, "পরবর্তী ইসরায়েলি হামলা আরও নৃশংস হবে, তাই পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে চুক্তি করতে হলে এখনই সময়।"
বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবারও অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। গত শুক্রবারের তুলনায় সোমবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৭ শতাংশ বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৪ দশমিক ৬০ ডলারে পৌঁছেছে। এই বৃদ্ধির প্রধান কারণ, হরমুজ প্রণালির ওপর যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব।
বিশ্বের মোট জলপথে পরিবাহিত তেলের এক-তৃতীয়াংশ—প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল—এই হরমুজ প্রণালির ওপর নির্ভর করে। মাত্র ৩৩ কিলোমিটার প্রস্থের এই নৌপথ বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল চলাচল পথ হিসেবে পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, তেহরান যদি এই প্রণালিটি সাময়িকভাবে হলেও বন্ধ করে দেয়, তবে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের ওপরে গিয়ে পৌঁছাতে পারে।
ইরানের সংবাদ সংস্থা ইরনা দেশটির প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ইসমাইল কোসারির বরাত দিয়ে জানায়, "হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার বিষয়টি চিন্তার মধ্যে রয়েছে।"
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ইরানের পক্ষে প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ করা আত্মঘাতী হবে। কারণ চীন, ভারতসহ যেসব দেশ ইরানের বড় তেল ক্রেতা, তারাও এই প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। ফলে এটি বন্ধ হলে ইরানও তার তেল রপ্তানি করতে পারবে না, যার ফলে দেশের রাজস্বে ভয়াবহ ধস নামতে পারে।
টিএস লম্বার্ডের বিশ্লেষক হামজেহ আল গাওদ বলেন, “হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত তেহরানের জন্য নিজ ঘাড়ে কুড়াল চালানোর শামিল হবে।”
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে উৎপাদন খরচে। বিশেষ করে খাদ্যশস্য, পোশাক, রাসায়নিক এবং পরিবহন খাতে এই প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে তা বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধীর করে ফেলবে।
বিশ্বের অনেক দেশ ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপে আছে, বিশেষ করে আমদানি-নির্ভর দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যের এই যুদ্ধ পরিস্থিতি যদি আরও ভয়াবহ হয়, তাহলে খাদ্যশস্য ও জ্বালানি আমদানিকারক দেশগুলোর ওপর গুরুতর চাপ পড়বে।
জি-৭ এর অনেক দেশ সম্প্রতি সুদের হার কমিয়ে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে চাচ্ছে। কিন্তু জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে তাদের সেই কৌশল ধাক্কা খাবে। হামজেহ আল গাওদ আল জাজিরাকে বলেন, “জ্বালানি খরচ বেড়ে গেলে মুদ্রানীতিতে শিথিলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।”
পৃথিবীর বড় বড় পুঁজিবাজার এই যুদ্ধের প্রভাব সরাসরি অনুভব করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক শুক্রবার ১.১ শতাংশ এবং নাসডাক সূচক ১.৩ শতাংশ কমেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বড় ধরনের পতন হয়েছে। মিসরের ইজিএক্স সূচক রোববার ৭.৭ শতাংশ এবং ইসরায়েলের তেল আবিব সূচক ১.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকিমুক্ত সম্পদ হিসেবে সোনায় বিনিয়োগ করছেন। এই প্রবণতা আরও বাড়বে যদি সংঘাত বাড়ে এবং বিশ্ববাজার আরও অস্থির হয়ে ওঠে।
এই যুদ্ধ কেবল অর্থনীতিতে নয়, কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যেও গভীর প্রভাব ফেলছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া এই সংকটকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে ব্যবহার করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো বড় সংঘাত ইসলামী রাষ্ট্রগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করে দেয়—একদিকে সুন্নি নেতৃত্বাধীন সৌদি আরব, অন্যদিকে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান। এই দ্বন্দ্ব আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
ইসরায়েল-ইরান সংঘাত এখন আর শুধু দুই দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নয়, এটি এক বৈশ্বিক অস্থিরতার রূপ নিচ্ছে। হরমুজ প্রণালি, তেলের বাজার, বিশ্ব পুঁজিবাজার, মূল্যস্ফীতি, এবং রাজনৈতিক জোট—সবকিছুই এই সংঘাতের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি দ্রুত কূটনৈতিক সমাধানের পথে না যাওয়া হয়, তাহলে এই যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে দ্বিতীয়বারের মতো বড় ধাক্কা দিতে পারে—যেমনটা হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অতএব, এখনই সময় আন্তর্জাতিক মহলের জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখার—এই যুদ্ধের আগুন যাতে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ