
ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েলি সেনারা আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) পরিচালিত গাজা উপকূলে পাঠানো ত্রাণবাহী ‘ম্যাডলিন’ নামের জাহাজটি আটক করে দখলে নিয়েছে। এ ঘটনা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ঘটে এবং জাহাজটিকে ইসরায়েলের আশদাদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটিতে ছিল ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং অন্যান্য মানবিক ত্রাণসামগ্রী।
গত ১ জুন ইতালির সিসিলির কাতানিয়া শহর থেকে ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটি যাত্রা শুরু করে গাজার দিকে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ত্রাণ প্রবেশের সংকট রয়েছে। গত ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার ত্রাণ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে, যার ফলে অনাহারে ভুগছে ফিলিস্তিনের অসংখ্য শিশু ও সাধারণ মানুষ। এ সংকটের মধ্যেই ‘ম্যাডলিন’ তাদের ত্রাণ পৌঁছে দিতে গিয়েছিল।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটিতে হানা দিয়ে সেটি আটক করেছে এবং সেখানে থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের অপহরণ করেছে। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রান্সেসকা আলবানিজ জানিয়েছিলেন, জাহাজটির ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এবং জানান, জাহাজ আটক করার সময় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে, ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটি আটক করা হয়েছে এবং এতে থাকা সকলকে ‘সেলফি ইয়ট’ ও অন্যান্য তথাকথিত ‘সেলিব্রিটিদের’ সঙ্গে নিরাপদে ইসরায়েলের উপকূলে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে তারা দাবি করেছে, এই অভিযান ছিল গণমাধ্যমকে প্ররোচনামূলক নাটক সাজিয়ে প্রচার লাভের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
‘ম্যাডলিন’ জাহাজটিতে ছিল বিশ্বখ্যাত পরিবেশ ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মীরা। সুইডেনের পরিবেশবিষয়ক আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, ফরাসি চিকিৎসক ও আন্দোলনকর্মী ব্যাপটিস্ট আন্দ্রে, আল জাজিরার সাংবাদিক ওমর ফায়াদ, ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসানসহ মোট ১২ জন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী এই ত্রাণবাহী জাহাজে ছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন জার্মানির ইয়াসেমিন আচার, ব্রাজিলের থিয়াগো আভিলা, পাস্কাল মৌরিয়েরাস, ইয়ানিস মোহামদি, তুরস্কের সুলাইব ওর্দু, স্পেনের সার্জিও তোরিবিও, নেদারল্যান্ডসের মার্কো ফন রেনেস এবং ফ্রান্সের রিভা ভিয়া।
তারা সবাই মানবিক সাহায্যের আওতায় গাজা উপকূলে পৌঁছে খাদ্য ও ওষুধ বিতরণ করার উদ্দেশ্যে ওই জাহাজে ছিলেন।
গত ২ মার্চ থেকে গাজা উপকূলে ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ থাকায় সেখানে মানবিক সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যের অভাবে বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে অনাহার ও মৃত্যু বাড়ছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে।
এই সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটি বেরিয়ে পড়েছিল, মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে। কিন্তু ইসরায়েলের পদক্ষেপ ত্রাণ সরবরাহে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের এই হস্তক্ষেপকে সমালোচনা করেছে এবং গাজার অবিলম্বে ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন মুখপাত্র গাজার জনগণের প্রতি মানবিক সাহায্য বাধাগ্রস্ত হলে কঠোর পরিণতি আসতে পারে বলে সতর্ক করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার কর্মীরা এই ঘটনাকে মানবিক আইন লঙ্ঘনের দৃষ্টিতে দেখছেন।
গাজা উপত্যকার দীর্ঘ সংকট ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের ঘটনা নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ থাকায় গাজার সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়ছে এবং শান্তি আলোচনা আরও জটিল হচ্ছে।
বিশ্ব সম্প্রদায় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গাজায় মানবিক সাহায্য অবাধে প্রবাহিত করতে ইসরায়েলের উপর চাপ বাড়াচ্ছে। মানবিক সাহায্যের পথ বন্ধ থাকায় গাজার নিরীহ জনগণের জীবনে আরও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি।
গাজা অভিমুখী ‘ম্যাডলিন’ ত্রাণবাহী জাহাজ ইসরায়েলের হাতে আটক হওয়ার ঘটনা মানবিক সংকটের প্রকট রূপ তুলে ধরেছে। এই সংকটের উত্তরণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানবিক নীতির সম্মান অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার পথে বাধাগ্রস্ত এই পদক্ষেপ গাজার সাধারণ মানুষের ওপর যে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে, তার জন্য বিশ্বকে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ