
ছবি: সংগৃহীত
বিতর্কিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৌহিদ আফ্রিদি। নাম শুনলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝলমলে কনটেন্ট, ফর্সা চেহারা আর অভিনব স্টাইলের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ উন্মোচন করেছে তার লুকানো কালো দিক—যেখানে প্রতারণা, নারী কেলেঙ্কারি, ভয়ভীতি, মাদক ব্যবসা আর ক্ষমতার অপব্যবহার মিলেমিশে তৈরি করেছে এক ভয়ংকর চক্র। ভুক্তভোগীদের ভাষায়, তিনি ছিলেন “অপকর্মের মাফিয়া”, আর নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন “ব্যাডবয় আফ্রিদি” হিসেবে।
বাবা-ছেলের অন্ধকার ব্যবসা
তৌহিদ আফ্রিদির উত্থানের পেছনে ছিলেন তার বাবা নাসির উদ্দিন সাথী। এক সময় সাধারণ কর্মচারী হলেও প্রতারণার মাধ্যমে মাই টিভি দখল করে সেটিকে ক্ষমতার দুর্গে পরিণত করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, সাথী টেলিভিশনের আড়ালে প্রভাব খাটিয়ে নানা ধরনের অপকর্ম চালাতেন, আর ছেলে আফ্রিদিকে নাম ভাঙিয়ে তরুণীদের পেছনে লাগিয়ে দিতেন। এভাবেই বাবা-ছেলে মিলে গড়ে তোলেন অপকর্মের সাম্রাজ্য।
মাই টিভি ছিল তাদের প্রধান হাতিয়ার। টিভির নাম ব্যবহার করে ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এমনকি সাধারণ মানুষের ওপরও দাপট দেখাতেন। কনটেন্ট ক্রিয়েটর বানিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আফ্রিদি অসংখ্য তরুণ-তরুণীর জীবন নষ্ট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
নারী কেলেঙ্কারি ও ব্ল্যাকমেইল
ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্য বলছে, আফ্রিদি সাধারণত তরুণীদের বিয়ে বা মডেল বানানোর প্রলোভন দেখাতেন। কেউ যদি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেত, তখনই প্রকাশ্যে আসত তার ভয়ংকর রূপ। গোপনে ধারণ করা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে ভুক্তভোগীদের বাধ্য করতেন নানান সম্পর্ক বজায় রাখতে।
একাধিক তরুণী অভিযোগ করেছেন, ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ দেখিয়ে আফ্রিদি নিজেকে অজেয় প্রমাণ করতেন। এমনকি গুলশান ও বনানীর আড্ডাকেন্দ্রগুলোতে মাদক সাপ্লাই থেকে শুরু করে বিত্তবানদের বিনোদনের জন্য তরুণীদের পাঠাতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ক্ষমতার ছায়াতলে আফ্রিদি
ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ এবং আওয়ামী সরকারের কিছু প্রভাবশালী মন্ত্রী-উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় চলতেন আফ্রিদি—এমন অভিযোগ এখন মুখে মুখে। অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, ক্ষমতার এই সম্পর্কের কারণে তারা মুখ খুলতে সাহস পাননি। যে কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নেমে আসত নানা হুমকি, এমনকি নির্যাতনও।
ডিবি হারুনের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ হিসেবে একাধিক ভিডিও ও ছবি প্রকাশিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, গোপন তথ্য বা ভিডিও সরানোর জন্য আফ্রিদি কনটেন্ট ক্রিয়েটরদেরও ব্যবহার করতেন।
মুনিয়া হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ
আলোচিত তরুণী মুনিয়ার মৃত্যু রহস্যেও তৌহিদ আফ্রিদির নাম ঘুরেফিরে আসছে। বিভিন্ন অডিও কল রেকর্ড ও সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে, মুনিয়ার সাথে আফ্রিদির সম্পর্ক শুধু ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং ঘটনাটিকে প্রভাবিত করার মতো ভূমিকা ছিল তার। তবে ক্ষমতার ছায়াতলেই তখন তাকে রক্ষা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতারণা ও সম্পত্তি দখল
নাসির উদ্দিন সাথীর বিরুদ্ধে রয়েছে সম্পত্তি দখলের অসংখ্য অভিযোগ। মাই টিভির প্রতিষ্ঠাতা বিলকিস বেগম নিজেই অভিযোগ করেছেন, কীভাবে বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তার টেলিভিশন দখল করে নেন সাথী। শুধু তাই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অসংখ্য ভবন ও জমি দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক আইনজীবীও জানান, সাথীর বিরুদ্ধে মামলা করেও কোনো সুরাহা পাওয়া যায়নি। কারণ তিনি টাকা, ক্ষমতা আর সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দাপট দেখাতেন।
সামাজিক আলোচনায় তৌহিদ আফ্রিদি
তৌহিদ আফ্রিদির নাম শুধু অপরাধচক্রে নয়, মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বারবার আলোচিত হয়েছে। নায়িকা দীঘির সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা, কিংবা যমজ বোন রাইসা-রিসাকে ঘিরে বিবাহ বিতর্ক—এসব কারণে বারবার ভাইরাল হয়েছেন তিনি। তবে ভুক্তভোগীদের মতে, এসব রঙিন কাহিনির আড়ালেই লুকিয়ে ছিল ভয়ংকর বাস্তবতা।
গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে আফ্রিদি
অবশেষে দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার পর গত রবিবার বরিশালের বাংলাবাজার এলাকায় সিআইডির বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হন তৌহিদ আফ্রিদি। এরপর রাতেই তাকে ঢাকায় আনা হয়। আদালতে তোলা হলে সিআইডি তার সাত দিনের রিমান্ড চায়, আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এই গ্রেপ্তারের পর ভুক্তভোগীরা একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। কনটেন্ট ক্রিয়েটর স্বপন আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, “এরা আমার জীবন থেকে এক বছর কেড়ে নিয়েছে। আমি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।” অন্যদিকে কনটেন্ট ক্রিয়েটর সায়েমও পুরোনো ঘটনার কথা প্রকাশ্যে এনেছেন।
তদন্ত ও ভবিষ্যৎ
সিআইডির মুখপাত্র বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান জানিয়েছেন, আফ্রিদির বিরুদ্ধে আসা প্রতিটি অভিযোগ যাচাই করা হবে। ভুক্তভোগীদের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, আফ্রিদি ও তার বাবার অপকর্ম কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ক্ষমতা, অর্থ আর সন্ত্রাসের মিশেলে তৈরি এক অন্ধকার জগত। এই চক্র ভাঙতে হলে স্বচ্ছ তদন্ত ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচও