
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া একটি ক্রমবর্ধমান সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, যার প্রভাবে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন, পরিবার হারিয়েছেন এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন। এই সামাজিক বিপর্যয় রোধে সরকার অবশেষে অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির (NCSA) মাধ্যমে একটি বৃহৎ অভিযানে ইতোমধ্যে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে যুক্ত এক হাজারেরও বেশি মোবাইল ফাইন্যান্সিং অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি রবিবার (২৫ মে) তার ফেসবুক পোস্টে জানান, সাইবার স্পেসে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ এবং নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
ফয়েজ তৈয়্যব বলেন, "সাইবার স্পেসে জুয়া সংক্রান্ত যেকোনো পোর্টাল, অ্যাপস, বা ডিভাইস তৈরি, পরিচালনা, খেলা, খেলায় উৎসাহ প্রদান, বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ এবং যেকোনো ধরনের প্রচার বা সহায়তা আইনত দণ্ডনীয়।"
তিনি জানান, অধ্যাদেশের ২০ ধারা অনুযায়ী এসব কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ২১ ও ২২ ধারায় জুয়া সংক্রান্ত যেকোনো আর্থিক লেনদেন, প্রতারণা বা জালিয়াতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, যারা আগে এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা এখনো যুক্ত রয়েছেন, তাদেরকে অবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দাবির সুযোগ পাবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনলাইন জুয়া শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুরবস্থা সৃষ্টি করে না, বরং পরিবারে মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা, মানসিক রোগ এবং আত্মহত্যার হারও বাড়িয়ে তোলে।
সাইবার অপরাধ বিশ্লেষক ড. মাহবুব হাসান বলেন, “অনলাইন জুয়া তরুণদের দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে ফেলে দেয়। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না এই খেলায় শেষ পর্যন্ত ক্ষতিই হয় বেশি। এটা নেশার মতো—প্রথমে লাভ, পরে সর্বস্বান্ত।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজা নাসরিন বলেন, “অনলাইন জুয়া সমাজে নতুন ধরণের বৈষম্য তৈরি করছে। কিছু লোক রাতারাতি প্রচুর অর্থ উপার্জনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পরিবার, কাজ, পড়াশোনা সবকিছু হারিয়ে ফেলছে। এটি শুধু একটি অপরাধ নয়, বরং সামাজিক দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন।”
এই অভিযানে শুধু অপারেটর, সফটওয়্যার কোম্পানি বা আর্থিক এজেন্টরাই নয়, বরং যারা অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারে অংশ নিয়েছেন—তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ফয়েজ তৈয়্যব। এর আওতায় সেলিব্রিটি, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানি, মিডিয়া হাউস এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপনগ্রাহকরাও পড়তে পারেন।
তিনি বলেন, “যদি কেউ মনে করেন তার অনুমতি ছাড়া তার ছবি/ভিডিও জুয়া খেলার ওয়েবসাইটে ব্যবহৃত হয়েছে, তবে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।”
ফয়েজ তৈয়্যব জানান, শুধু এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম) অ্যাকাউন্টই নয়, বরং যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রেগুলার ব্যাংক, ডিস্ট্রিবিউটর বা ক্রিপ্টো ব্রোকাররা জুয়ার সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন লঙ্ঘনকারীদের মধ্যে কেউ ধরা পড়লে তার লাইসেন্স বাতিলসহ কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করা হতে পারে।
এই অপরাধ নির্মূলে সাধারণ জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে সরকার একটি নির্দিষ্ট ইমেইল ঠিকানা ([email protected]) দিয়েছে, যেখানে অনলাইন জুয়া, মোবাইল ব্যাংকিং, হুন্ডি বা ক্রিপ্টো সংক্রান্ত সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানানো যাবে।
বাংলাদেশ সরকার যে এবার সাইবার জুয়ার বিরুদ্ধে ‘সবচেয়ে কঠিন অবস্থানে’ গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাইবার নিরাপত্তা, আর্থিক লেনদেন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এই ধরনের পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্য হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি গণসচেতনতা গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে অনলাইন জুয়ার ঝুঁকি থেকে দূরে রাখতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়ার সম্মিলিত ভূমিকাই হবে সবচেয়ে কার্যকর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ