
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলো নারায়ণগঞ্জ কর অঞ্চলে। মাত্র কয়েক দিনের এক অসাধারণ প্রচেষ্টায় মাঠপর্যায়ের একদল কর কর্মকর্তা সোনালী ব্যাংকের রূপগঞ্জ শাখা থেকে প্রায় ৫২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করতে সক্ষম হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে চলতি অর্থবছরের জুন মাসের শুরুতে, যখন বাজেট ঘোষণার ঠিক আগে রাজস্ব আহরণ নিয়ে সারাদেশে চাপ বাড়ছিল।
মে মাসের শেষদিকে কর অঞ্চল-নারায়ণগঞ্জের কমিশনার আমিনুর রহমান একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত কর কমিশনার মর্তুজা (রেঞ্জ-১ ও ২), যুগ্ম কর কমিশনার রাসেল (রেঞ্জ-৩ ও ৪), এবং সদর দপ্তরের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা উপকর কমিশনার পার্থ। বৈঠকে জুন মাসের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞ কর্মকর্তা শাহরিয়ার, এম এ হাশেমসহ কয়েকজন মিলে বিভিন্ন সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে টিডিএস কর্তন ও জমা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়—রূপগঞ্জ ও রূপগঞ্জ পূর্ব সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে বিশেষ অভিযান চালানো হবে।
জুনের ১ তারিখ সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে হেড অফিস থেকে দুটি গাড়িতে ৮ জন কর্মকর্তা রওনা হন। প্রায় তিন ঘণ্টা যাত্রার পর তাঁরা পৌঁছান রূপগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে। সেখানে দলিল রেজিস্ট্রেশন, পে-অর্ডার ও চালান যাচাই করতে গিয়ে তাঁরা একাধিক অনিয়মের ইঙ্গিত পান। গরমিল যে আসলে ব্যাংক লেনদেনেই, তা টের পেয়ে কর্মকর্তারা দ্রুত সোনালী ব্যাংক, রূপগঞ্জ শাখায় যান।
ব্যাংকে গিয়ে তাঁরা এক আশ্চর্য দৃশ্যের সম্মুখীন হন। শাখার এজিএম (ব্যবস্থাপক) অকপটে স্বীকার করেন যে কয়েক মাস ধরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ব্যাংকের হিসাবেই আটকে রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কোনো গোপনীয়তা না করে তিনি সরাসরি দায় স্বীকার করেন। কর কর্মকর্তারা তাঁকে জানান—বিষয়টি লঘু নয়, প্রায় ৫২ কোটি টাকা সরকারি অর্থ আটকে রাখা হয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২০ দিনের সময় চাইলে কর্মকর্তারা সোজাসাপটা জানিয়ে দেন, ঈদের আগে সর্বোচ্চ ৪ দিনের মধ্যে অর্থ জমা দিতে হবে।
প্রথম দিন রাত ১০টা পর্যন্ত ব্যাংকে বসে থেকেই কর কর্মকর্তারা প্রায় ১৫ কোটি টাকা কোষাগারে জমা করান। দ্বিতীয় দিন হেড অফিসে মিটিংয়ে কমিশনার ও রেঞ্জ কর্মকর্তারা অভিযানের প্রশংসা করেন এবং পুরো টিমকে বিশেষ সুবিধা দেন। তাঁদের জন্য সরকারি গাড়ি সার্বক্ষণিক চালু রাখা হয়, এমনকি দুপুরের খাবার খরচও ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এই সহযোগিতা মাঠ পর্যায়ের টিমকে নতুন উদ্দীপনা দেয়।
৪ দিনের নিরলস প্রচেষ্টায় ১২২টি চালানের মাধ্যমে আয়কর বাবদ ৩৬.৫০ কোটি টাকা এবং ১৬৬টি চালানের মাধ্যমে কাস্টমস বাবদ ১৫.৫০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়। মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, পরে আরও কয়েকজন কর্মকর্তা একই কৌশল অনুসরণ করে কয়েক কোটি টাকা আদায় করেন।
এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল কমিশনার আমিনুর রহমানের পিতাসুলভ দিকনির্দেশনা, রেঞ্জ কমিশনারদের সহযোগিতা, সদর দপ্তরের সহমর্মিতা এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম। কর কর্মকর্তা এম এ হাশেম এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন—“এই অভিযানে শাহরিয়ার ভাই, সাদনান, শাকিল, রফিক ভাই, উজ্জ্বল দা, এমদাদ ভাই, কামরুজ্জামান ভাই ও কামরান ভাই ছিল আমাদের সত্যিকারের সৈনিক।”
অভিযানটি শুধু ৫২ কোটি টাকা আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সরকারি অর্থ আটকে রাখার মতো ভয়াবহ অনিয়ম চিহ্নিত করার একটি সফল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি রাজস্ব প্রশাসনের জন্য এক ঐতিহাসিক বিজয়, যা দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এসজে