
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অস্বচ্ছ নিয়োগ—এসব কারণে একের পর এক বেসরকারি ব্যাংক টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যর্থ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো দুর্বল পাঁচ বেসরকারি ব্যাংকের (এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়নসহ) একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত।
কয়েক মাস আগে ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে সহায়তা দিয়েছিল। তবে এত বিপুল অর্থপ্রবাহ সত্ত্বেও কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। বরং গত এক বছরে গ্রাহকের আস্থা আরও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত কেবল এই পাঁচ ব্যাংক থেকেই প্রায় ২২ হাজার ৬০ কোটি টাকা আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। খেলাপি ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা তাদের মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার এখন নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে—ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বোঝা সরাসরি সরকারের ওপর পড়বে। বাকি অর্থ আসবে আমানত বিমা তহবিল, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে। একীভূত করার আগে ব্যাংকগুলোর সব শেয়ার শূন্য করে দেয়া হবে এবং ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী জানান, “ডিপোজিট ইন্সুরেন্সে প্রচুর অর্থ জমা রয়েছে। প্রয়োজনে সরকার চাইলে সেখান থেকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব।”
তবে আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা এই একীভূতকরণকে টেকসই সমাধান মনে করছেন না।
বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক চৌধুরী বলেন, “প্রশ্ন হলো—এত টাকা ঢেলে কী লাভ হলো? কয়েক মাস আগেই সরকার তাদের সহায়তা দিয়েছে, কিন্তু তাতে কি ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে? বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তাই আবারও টাকা খরচ না করে তাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা চাওয়া উচিত। নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হোক। যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারে ভালো, না পারলে বন্ধ করে দিতে হবে।”
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “একীভূতকরণ মূল সমস্যার সমাধান নয়। খেলাপি ঋণ, রাজনৈতিক প্রভাব, অদক্ষ পরিচালনা—এসব দূর না করলে কোনো উদ্যোগ টেকসই হবে না। প্রয়োজনে কিছু ব্যাংককে বন্ধ করে দেওয়া উচিত, যাতে গোটা ব্যাংকিং খাতকে রক্ষা করা যায়।”
বিশ্লেষকদের মতে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বারবার সরকারি সহায়তা দেওয়ার ফলে কেবল রাষ্ট্রীয় অর্থই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বরং সুস্থ ব্যাংকগুলোও ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তারা মনে করছেন, বারবার ‘টাকা ছাপানো’ ও সরকারি প্রণোদনা দিয়ে দুর্বল ব্যাংক টিকিয়ে রাখা গ্রাহকের আস্থার আরও অবক্ষয় ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান অবশ্য ভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ধরা যাক তিনটি ব্যাংক একীভূত হলো। বাজারে তাদের শেয়ারের দাম ভিন্ন হলেও একীভূত করার সময় গড় মূল্য ধরে নেওয়া হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা আসবে।”
তবে ব্যাংক খাতের সংকট এভাবে চলতে থাকলে পুরো আর্থিক খাতই অচল হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সময় এসেছে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
বাংলাবার্তা/এমএইচও