
ছবি: সংগৃহীত
আয়কর রিটার্নে করদাতাদের সম্পদের বিস্তারিত তথ্য জমা দেওয়ার বিধান নতুন নয়, তবে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ছয় ধরনের করদাতার জন্য সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বাধ্যতামূলক করেছে। এর ফলে শুধুমাত্র বড় আয়ের করদাতার জন্য নয়, বরং নির্দিষ্ট অবস্থার অধীনে থাকা সকল করদাতার জন্য সম্পদের পরিসংখ্যান জমা দেওয়া এখন আইনি বাধ্যবাধকতা। করদাতাদের জন্য এই সম্পদ বিবরণী আইটি-১০বি (২০০৩) ফরমের মাধ্যমে জমা দিতে হবে, যেখানে ব্যক্তির পরিসম্পদ, দায়, ব্যয় এবং অন্যান্য আর্থিক তথ্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়।
এই নতুন নিয়মে এনবিআর ছয় শ্রেণির করদাতাকে লক্ষ্য করেছে, যারা বিভিন্ন কারণে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে বাধ্য।
১. সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী: যেসব করদাতা সরকারি চাকরিজীবী, তাদের জন্য প্রতিবছর আয়কর রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের উত্থান-পতন, বৈষম্য এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন রোধের উদ্দেশ্যে এই ধারা প্রবর্তিত। এনবিআরের অভ্যন্তরীণ হিসাব ও নিরীক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া অপরিহার্য।
২. ৫০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ: যদি একজন করদাতার স্থাবর ও চলমান সম্পদের মোট মূল্য ৫০ লাখ টাকার বেশি হয়, তা হলে রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এই মূল্যায়ন কেবল বর্তমান বাজারমূল্য অনুসারে হবে। এখানে বাড়ি, প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট বা অন্যান্য স্থাবর সম্পদ অন্তর্ভুক্ত। করদাতাদের অবশ্যই দেখাতে হবে তারা কখন এবং কোন মূল্যে এই সম্পদ অর্জন করেছেন।
৩. সিটি এলাকায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট: সিটি করপোরেশন এলাকায় সম্পদ থাকা, যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বা অন্যান্য শহরে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট থাকা ব্যক্তির জন্যও সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এমন করদাতা ৫০ লাখ টাকার সীমা অতিক্রম না করলেও ধনী হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এই ধারা প্রযোজ্য।
৪. গাড়ির মালিক: যদি কোনো করদাতার একটি বা একাধিক গাড়ি থাকে, তবে সেই তথ্যও রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে। যদিও মোট সম্পদ ৫০ লাখ টাকার বেশি না হতে পারে, গাড়ি থাকায় সম্পদের বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক। গাড়ি, মোটরসাইকেল, লজিস্টিক যানবাহনসহ সকল বাহ্যিক সম্পদ এখানে অন্তর্ভুক্ত।
৫. বিদেশে সম্পদ: যদি কোনো করদাতার দেশের বাইরে স্থাবর বা চলমান সম্পদ থাকে, তখনও রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। দেশের বাইরে থাকা সম্পদের তথ্য এনবিআরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা বজায় থাকে। এখানে বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, স্থাবর সম্পদ, শেয়ার, বা অন্য কোনো বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত।
৬. কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক: যারা কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের জন্যও সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে সম্পদের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা অতিক্রম না করলেও সমস্ত আর্থিক তথ্য রিটার্নে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কোম্পানি পরিচালনা বা শেয়ারহোল্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শন করা হয়, তাই এই ধারা প্রযোজ্য।
এনবিআরের একাধিক সূত্র জানায়, এই নিয়মের উদ্দেশ্য হচ্ছে করদাতাদের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, অবৈধ সম্পদ অর্জন প্রতিরোধ করা এবং কর ব্যবস্থার ন্যায়বিচার বজায় রাখা। সম্পদ বিবরণী জমা না দিলে আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারা শুধু উচ্চ আয়ের ব্যক্তিদের জন্য নয়, বরং দেশের সমস্ত করদাতাকে আর্থিক জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কর প্রশাসনকে শক্তিশালী করবে, কর দাখিলের শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করবে এবং দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর করবে।
এনবিআর আশা করছে, এই ধারা কার্যকর হলে করদাতাদের মধ্যে কর দাখিলের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে, আর্থিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজস্ব সংগ্রহের সক্ষমতা উন্নত হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে