
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে প্রতিবছরই থাকে আলোচনা-সমালোচনা। দেশের বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি, মজুতদারি কিংবা নিষিদ্ধ সময়ে জাটকা ধরা—সবকিছুই বারবার উঠে আসে জনমনে। তবে এবার সামনে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য—বাংলাদেশ থেকে বৈধ পথে ভারতে রপ্তানি হওয়া ইলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ট্রানজিট মাছ’ হিসেবে। কলকাতায় পৌঁছানোর পর সামান্যই স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আসল খেলা হচ্ছে অন্য জায়গায়—ভারতকে ব্যবহার করে সেই ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, যেখানে বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে। খবর প্রকাশ্যে আসতেই বন্ধ হয়ে গেছে ইলিশ রপ্তানি।
বাংলাদেশ থেকে প্রতি কেজি ইলিশ সংগ্রহ করতে ব্যবসায়ীদের খরচ হচ্ছে প্রায় ১,৯০০ থেকে ২,০০০ টাকা। বরফ, প্যাকিং আর পরিবহন খরচ যোগ হয়ে ভারত পৌঁছাতে ব্যয় দাঁড়ায় ২,১০০ থেকে ২,২০০ টাকা। ডলারে যার মূল্যমান প্রায় ২০ থেকে ২১ ডলার। অথচ সরকার নির্ধারিত রপ্তানি মূল্য রাখা হয়েছিল কেজিপ্রতি মাত্র ১২.৫ ডলার বা ১,৫২৫ টাকা। এই হিসাবে বৈধ পথে ভারতে রপ্তানি করলে প্রতি কেজিতে লোকসান গুনতে হচ্ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
কিন্তু এখানেই আসল ফাঁদ। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই ইলিশ পুনঃরপ্তানি হচ্ছিল তৃতীয় দেশে, যেমন সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। সেসব বাজারে পদ্মার ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল কেজিপ্রতি ৪০ থেকে ৪৫ ডলার দরে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে লাভ দাঁড়াচ্ছিল প্রায় ২০ থেকে ২৪ ডলার বা ২,৮০০ টাকা পর্যন্ত। পুরো প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ছিল সীমান্ত পারের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। কলকাতার হাওড়া, বশিরহাট, বারাসাত—সব জায়গাতেই বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের আড়ত ও ফ্ল্যাট রয়েছে। একাধিক ব্যবসায়ী নিশ্চিত করেছেন, বছরের পর বছর এভাবেই চলছে এই পাচারচক্র।
বাংলাদেশ ২০০৭ সালেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে বিশেষ অনুমতিতে সীমিত পরিমাণ ইলিশ পাঠানো হয়। এবারের কোটায় অনুমতি ছিল ১,২০০ টন ইলিশের। কিন্তু রপ্তানি শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই প্রশ্ন উঠেছিল, দেশের বাজারে কেজি ১,৮০০ টাকায় বিক্রি হওয়া মাছ মাত্র ১,৫২৫ টাকায় রপ্তানি করা হচ্ছে কিভাবে? তখনই স্পষ্ট হয়েছিল লোকসান দিয়েও এই ব্যবসায়ীরা আসলে অন্য কোনো ফায়দা লুটছে।
বাংলাদেশি অন্তত চারজন বড় রপ্তানিকারকের আড়ত আছে কলকাতায়। এদের মধ্যে আলোচিত নাম নীরব হোসেন টুটুল। তার শ্বশুরবাড়ি কলকাতার বশিরহাটে। একসঙ্গে চারটি লাইসেন্সে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি পেয়েছেন তিনি। এছাড়া সেভেন স্টার ফিশ প্রসেসিং করপোরেশন ও কেবিসি নামের দুটি প্রতিষ্ঠানও কলকাতার হাওড়া বাজারে ব্যবসা চালাচ্ছে। তাদের একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। স্থানীয় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের নাম ব্যবহার করে তারা লাইসেন্স নিয়েছেন এবং সেই লাইসেন্সে বাংলাদেশি ইলিশকে পুনঃরপ্তানি করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে।
গত শনিবার পাবনার সেভেন স্টার ফিশ প্রসেসিং করপোরেশনের দুটি ট্রাক ইলিশ বেনাপোল বন্দরে গিয়ে দাঁড়ায় রপ্তানির জন্য। কিন্তু পরে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদল করে ফেরত আনা হয় ট্রাকগুলো। সোমবার সংবাদমাধ্যমে ভারত হয়ে ইলিশ পাচারের বিস্তারিত প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানি। এরপর রপ্তানিকারকরা দাবি করতে থাকেন, আসল কারণ নাকি লোকসান—বাজারে কিনতে হচ্ছে বেশি দামে, অথচ রপ্তানির দাম কম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, লোকসানের হিসাব আগেই জানা ছিল, তবু কেন ট্রাক পাঠানো হলো সীমান্তে?
বাংলাদেশ ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিজামউদ্দিন বলেছেন, “ক্রেতা ঠিক না করে কখনো পাইকারি বাজার থেকে মাছ সংগ্রহ করা হয় না। রপ্তানির জন্য ট্রাক পাঠিয়ে ফেরত আনার পেছনে অন্য কারণ আছে, সেটা সরকার খতিয়ে দেখা উচিত।”
বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি এবায়েদুল হক চানও অভিযোগ করেছেন, বহুদিন ধরে একটি সিন্ডিকেট এই অপকর্ম চালাচ্ছে। এবার সব ফাঁস হয়ে যাওয়ায় রপ্তানি বন্ধ করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদ বলেছেন, “আমরা কোনো তৃতীয় দেশে ইলিশ পাঠাই না। আসল ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের দাম এত বেশি যে এই দামে আমদানি করলে আমাদের ক্ষতি হয়। তাই আমরা আর ইলিশ নিতে চাই না।” কিন্তু প্রথম তিন দিনে প্রায় ৭ হাজার কেজি ইলিশ আমদানি হওয়ার পর হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত—সে প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারেননি।
কলকাতার কয়েকজন সংবাদকর্মী ও ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার হোটেলগুলোতে দেদার চলছে পদ্মার ইলিশ বিক্রি। স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিজেরাই জানিয়েছেন, মাছগুলো ভারত হয়ে আসছে। এতে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে, কলকাতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক ইলিশ পাচারের নেটওয়ার্ক।
রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত বৈধ পথে একটি ইলিশও সীমান্ত পার হয়নি। হঠাৎ রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় নতুন প্রশ্ন উঠছে—এখন কি এই সিন্ডিকেট শুধু সময় নিচ্ছে, নাকি সরকার সত্যিই এর গভীরে গিয়ে তদন্ত শুরু করবে? অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত না হলে আগামী বছরও একই নাটক নতুন করে মঞ্চস্থ হবে।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট, ভারতে রপ্তানির নামে দীর্ঘদিন ধরে ইলিশ পাচার হচ্ছিল বিশ্ববাজারে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর আপাতত বন্ধ হয়েছে রপ্তানি, তবে সাধারণ মানুষ এখন সরকারের দিকে তাকিয়ে—কতদূর খোঁজ নিয়ে আসল চক্রকে আইনের আওতায় আনা হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ