
ছবি: সংগৃহীত
এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে শামীম ওসমানের দোসর ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের খুনী দালাল আমজাদ। পুলিশ প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনও দালাল আমজাদ নির্বিঘ্নে তার অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এখনও এই দালাল আমজাদের নামে কোনো মামলা হয় নি। বিএনপির নেতাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে এলাকায় বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে যাচ্ছে সে। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের জনপদ সাইনবোর্ড, ভূইঁগড়, জালকুড়ি, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা ও বন্দরে যত হত্য্য, গাড়ি-দোকান ভাংচুর, গাড়ি পোড়ানো ও লুটতরাজ হয়েছে তার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল জালকুড়ি উত্তরপাড়ার ৯ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও এলাকার চিহ্নিত দালাল, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী ও মাদক কারবারী মো: আমজাদ হোসেন।
এলাকার বাসিন্দাদের ভাষ্যে, আমজাদ হোসেন বহু বছর ধরে স্থানীয় চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, এবং দালালি সিন্ডিকেটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ার সুবাদে তিনি একের পর এক ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করেও থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকার মানুষ তাকে এক নামে চেনে—‘দালাল আমজাদ’। অথচ এই অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিটি দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের চোখের সামনে দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা জনসাধারণের কাছে এক বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—আমাদের ভাই কবরে, খুনি আমজাদ কেন এখনও বাইরে? পুলিশ প্রশাসন কি ক্ষমতাহীন?
শামীম ওসমানের সাথে চিহ্নিত দালাল, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী ও মাদক কারবারী আমজাদ
ছাত্র আন্দোলন দমনে পরিকল্পক ও অর্থদাতা
তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের সকল অর্থের যোগান দাতা ও পরিকল্পনাকারীও ছিল আমজাদ হোসেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ ৪ আসনের বোরকা পড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অন্যতম দোসর ছিল। গত ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি এলাকায় ভারী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগোচ্ছেন শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী এ রকম এক ভিডিওতেও তার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ভিডিওটি দেখতে ক্লিক করুন।
এ আন্দোলনে নিহত, নিখোঁজ ও আহত অনেক তরুণের পরিবার আজও বিচার পায়নি। অনেকেই আজও ঘরছাড়া। কিন্তু তাদের কণ্ঠে একটাই প্রশ্ন—আমজাদ হোসেন কেন গ্রেপ্তার হচ্ছে না?
বিএনপি-জামায়াতকে হুমকি দিয়ে পোস্ট
শামীম ওসমানের ছায়াতলে বিকশিত এক অপরাধ সাম্রাজ্য
এছাড়া বিগত সরকারের আমলের সব জাতীয় নির্বাচনের আগে দালাল আমজাদ হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লার সকল বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের নাম তালিকা করে, সেই তালিকা শামীম ওসমানকে পাঠাতো। পরে ওসব নেতাদেরকে মিথ্যা হয়রানিমূলক বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হতো।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় না থাকলেও আমজাদ হোসেন তার অপরাধ কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। সাইনবোর্ড, ভূঁইগড়, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকার চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অটোরিকসা স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজি, বাড়ি তৈরির সময় চাঁদা, বাড়ির রাস্তার দেয়ার নামে দু’পক্ষের থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন বিচার সালিশের নামে দু’পক্ষের থেকে টাকা আদায়সহ সব ধরনের অপরাধ নির্বিঘ্নে এখনও তিনি ও তার বাহিনী করে যাচ্ছে।
১৫ই আগষ্টের শোক প্রকাশে এলাকার চিহ্নিত মাদক কারবারী আমজাদ
জমি-বাড়ি ও রাস্তার নামে কোটি টাকার চাঁদাবাজি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জালকুড়ি উত্তরপাড়াতে স্থায়ীভাবে বসবাসরত একজন জানান, আমি সাভারে থাকতাম পরিবার নিয়ে। এরপর ২০১৬ সালে পরিচিত একজনের মাধ্যমে আমজাদ হোসেনের সাথে পরিচয় হয়। পরে আমজাদ হোসেনের দালালিতে ৬ কাঠা জমি ক্রয় করি জালকুড়ি উত্তরপাড়াতে। এরপর ২০২২ সালে বাড়ি করতে গেলে আমজাদ হোসেন তার পরিচিত শিবু মার্কেটের এক ব্যবসায়ির কাছ থেকে (কম দামে ও মানে ভালো) বালু, সিমেন্ট ও রড কিনতে বলে এবং নিজেই রাজমিস্ত্রি ঠিক করে দেবে বলে জানায়। আমজাদ হোসেনের মিষ্টি ভাষা ও ব্যবহারে আমি তার ফাঁদে পা দেই।
ভুক্তভোগী জানান, আমি প্রথমে সেখান থেকেই কিনতাম। কিন্তু দাম বেশি ও পরিমাণে কম দেয়ায় আমি কেনা বন্ধ করে দেই। আর রাজমিস্ত্রিরা তো একদিনের কাজ তিন দিনে করতো। এমন অবস্থায় আমি নতুন রাজমিস্ত্রি ঠিক করি। এরপর কয়েকজন এসে ৮ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। দিতে অস্বীকার করলে প্রতিনিয়ত হুমকি দিতে থাকে। এরপর রাতের আধারে প্রতিনিয়ত রড, সিমেন্টের বস্তা চুরি হতে থাকে। এরপর ছাদ ঠালাইয়ের দিন চাঁদা চাওয়া লোকজন এসে কাজ বন্ধ করে দেয়। এসময় আমজাদ হোসেন ফোন দিয়ে ছাদ ঢালাইয়ের কাজ কেমন চলছে জানতে চায়। চাঁদা ও কাজ বন্ধের বিষয়ে তাকে জানালে সে বলে- আমাকে খুশি করেন; বাকি সব আমি ম্যানেজ করে নিবো। পরে দুই ধাপে আমজাদ হোসেনকে ৪ লাখ টাকা দেই ও পুনরায় শিবু মার্কেটে তার পরিচিত দোকান থেকে মালপত্র কিনতে বাধ্য হয়েই বাড়ি তৈরির কাজ শেষ করি।
ভুক্তভোগী আরও জানান, এরপর শুরু হয় রাস্তা দেয়ার নামে চাঁদা আদায়। কাঠাপ্রতি ১৫ হাজার করে ৬ কাঠার জন্য মোট ৯০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে আমজাদ হোসেন। এটা ৯নং ওয়ার্ডের সব বাড়ি তৈরির পর রাস্তার জন্য কাঠাপ্রতি নির্ধারিত চাঁদা ছিল তার। কেউ টাকা না দিলে বাড়ি তৈরি করলেও কোনো রাস্তা ব্যবহার করতে পারতো না।
এই ভুক্তভোগী আরও জানান- জমি কেনা, বাড়ি তৈরির মালামাল, রাজমিস্ত্রি, বাড়ি তৈরির সময় চাঁদা ও রাস্তার চাঁদা সব মিলিয়ে আমার কাছ থেকে প্রায় ১০/১২ লাখ টাকা নিয়েছে আমজাদ হোসেন।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে জানান নি কেন; রিপোর্টারের এমন প্রশ্নে এই ভুক্তভোগী জানান, তখন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। জানালে এই এলাকায় আর থাকা লাগতো না। আর ক্ষমতা পরিবর্তনের পরও আমজাদ হোসেনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম একটুও কমেনি।
একই ধরনের ভুক্তভোগী এবং ঘটনার স্বাক্ষী সিদ্ধিরগঞ্জের রেজাউল ইসলাম, আনিসুল ভূইয়া, সোলেয়মান হোসেনসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও অনেকে, ভূঁইগড়ের সুমন মিয়া, সজল মিঞাসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও অনেকে, সাইনবোর্ডের আজগর আলী, রহমত উল্লাহ (ব্যাংক কর্মকর্তা), ঝন্টু উল্লাহ্সহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও অনেকে এবং ফতুল্লার দেলোয়ার হোসেন, মোমেন মিয়া, মো: আকাশসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও অনেকে।
শামীম ওসমানের সাথে মাদক কারবারি আমজাদ
বিস্তৃত অপরাধ নেটওয়ার্ক: কিশোর গ্যাং ও মাদক
জালকুড়ি ও সিদ্ধিরগঞ্জে রয়েছে তার নিয়ন্ত্রিত কিশোর গ্যাং। সেই কিশোর গ্যাংয়ের এক সদস্য হলো ইয়াবা, গাঁজা ও ফেনসিডিল বিক্রেতা সুজন। তার সাথে এই রিপোর্টার পরিচয় গোপন রেখে সখ্যতা গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে এই মাদকের মূল হোতা কে? জানতে চাইলে প্রথমে না বলতে চাইলেও পরে কাউকে না জানানোর শর্তে সে জানায়- আমজাদ হোসেন।
এছাড়া সাইবোর্ড, ভূঁইগড়, রুপগঞ্জ ও বন্দরের বিভিন্ন এলাকায়ও তার চুরি, ছিনতাই ও ডাকাত বাহিনী রয়েছে। যারা নির্বিঘ্নে অপরাধ করে যাচ্ছে।
শামীম ওসমানের সাথে মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী আমজাদ
টাকা আত্মসাৎ ও কোর্টে মিথ্যা স্বাক্ষী
ভূঁইগড়ের রুপম নামে একজনকে সৌদি আরবে পাঠানোর কথা বলে ৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন আমজাদ। টাকা ফেরত চাইলে ভয় দেখিয়ে বলেন, “মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেব।” এমনই অভিজ্ঞতা রয়েছে রুপগঞ্জ, সাইনবোর্ড ও ফতুল্লার অনেকের।
এছাড়া বিভিন্ন চলমান মামলায় টাকার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষীও দিয়ে থাকেন আমজাদ হোসেন। তার এ রকম একটি বাহিনী রয়েছে যারা টাকার বিনিময়ে মিথ্যা স্বাক্ষী দিয়ে থাকে।
এলাকার সালিশে চোর-ডাকাত সর্দার আমজাদ
ভুয়া সার্টিফিকেট, মিথ্যা পরিচয়
নিজেকে মেট্রিক (এসএসসি) পাস দাবি করলেও তার ৫ম শ্রেণি পাসের সার্টিফিকেট আছে। সব জায়গায় নিজেকে ব্যবসায়ি দাবি করলেও তার মূল পেশা হলো চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও দালালি।
মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে ভণ্ডামি
নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করলেও জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর ৩ মাস। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে তার বয়স দাঁড়ায় ১২ বছর। অথচ সরকার ঘোষিত নীতিমতে, সাড়ে ১২ বছরের কম কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে না (নিচে ভোটার আইডি কার্ড সংযুক্ত করা হয়েছে)। কিন্তু এলাকায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সম্মান, সুযোগ-সুবিধা এবং জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন আমজাদ।
দালাল আমজাদ হোসেনের ভোটার আইডি কার্ড
প্রশাসনের নীরবতা ও মানুষের ক্ষোভ
আমজাদ হোসেনের বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শাহিনুর আলম জানিয়েছেন, “খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” কিন্তু এলাকাবাসীর প্রশ্ন—কত বছর ধরে এসব অপরাধ হচ্ছে? কেন এতদিন কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি? কেন আমজাদের মতো একজন দাগী আসামি এখনও গ্রেপ্তার হয়নি?
জালকুড়ি, ভূইঁগড়, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা, সাইনবোর্ড ও বন্দর এলাকার সাধারণ মানুষের একটাই দাবি—এই দালাল, চাঁদাবাজ, খুনি ও মাদক কারবারিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
তারা বলেন, “আমরা আর চুপ থাকতে পারছি না। আমজাদের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে আছি। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে রাতে গুম, দিনে মামলা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমাদের স্পষ্ট আহ্বান—এই অপরাধীকে রাস্তায় দেখা মাত্রই গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক। জনগণ আপনাদের পাশে থাকবে।”
৯নং ওয়ার্ডের সভাপতি পদপ্রার্থী ছিল দালাল আমজাদ, কিন্তু মাদক কারবারি-সন্ত্রাসী ও ৫ম পাস বলে তাকে সহ-সভাপতি পদ পেতে হয়
জেলার সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও যৌথ বাহিনির কাছে জালকুড়ি-ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি দালাল, বাটপার, চাদাঁবাজকারী, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি আমজাদ হোসেনকে গ্রেফতার করে দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা হোক।
৯নং ওয়ার্ডের সভাপতি পদপ্রার্থী ছিল দালাল আমজাদ, কিন্তু মাদক কারবারি-সন্ত্রাসী ও ৫ম পাস বলে তাকে সহ-সভাপতি পদ পেতে হয়
তথ্যসূত্র: জালকুড়ি, সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা ও ভূইঁগড় এলাকার একাধিক ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী।
আগের নিউজটি পড়তে ক্লিক করুন: https://www.banglabartabd.com/country/news/9176
বাংলাবার্তা/এসজে