
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি খাত পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজারে বড় আঘাত এসেছে ভারতের নতুন বাণিজ্য নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে। সোমবার (১১ আগস্ট) ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বৈদেশিক বাণিজ্য মহাপরিচালকের কার্যালয় (ডিজিএফটি) এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ থেকে চার ধরনের পাটপণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির ওপর হঠাৎ করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানিকারকদের জন্য ভারতের সবচেয়ে সহজ ও সস্তা রপ্তানি রুট—স্থলপথ—প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যেসব পণ্যের ওপর এই নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, সেগুলো হলো—
পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের কাপড়
পাটের দড়ি বা রশি
পাটজাতীয় পণ্য দিয়ে তৈরি দড়ি বা রশি
পাটের বস্তা বা ব্যাগ
ডিজিএফটির প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সিদ্ধান্তটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে এবং স্থলবন্দর দিয়ে এসব পণ্যের আমদানি আর করা যাবে না। ফলে ভারতের ব্যবসায়ীরা যদি এসব পণ্য কিনতে চান, তবে তা কেবল সমুদ্রপথে পাঠানো যাবে, তাও আবার মুম্বাইয়ের নভসেবা (Nhava Sheva) বন্দরের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ থেকে এই চার ধরনের পাটপণ্যের রপ্তানির ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতি হলো—মোট রপ্তানির প্রায় ৯৯ শতাংশই এখন পর্যন্ত স্থলবন্দর দিয়ে হয়। বিশেষ করে বেনাপোল, আখাউড়া, হিলি ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন বড় পরিমাণে এসব পণ্য ভারতীয় ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে সমুদ্রপথে ভারতের দিকে এসব পণ্য পাঠানোর হার মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি। কারণ, সমুদ্রপথে পরিবহন সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং পণ্য পরিবহনের শৃঙ্খল জটিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের রপ্তানিকারকদের জন্য সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানো সময় ও খরচ উভয় ক্ষেত্রেই বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
এর আগে গত ২৭ জুন ডিজিএফটি বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে আরও কয়েক ধরনের পণ্য আমদানির ওপর বিধিনিষেধ দিয়েছিল। সেই তালিকায় ছিল—কাঁচা পাট, পাটের রোল, পাটের সুতা এবং বিশেষ ধরনের কাপড়। নতুন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ওই তালিকায় চারটি নতুন পণ্য যোগ হলো, যার ফলে এখন মোট আট ধরনের পাট ও পাটজাত পণ্য স্থলপথে ভারতে পাঠানো যাবে না।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এই ধারাবাহিক বিধিনিষেধ মূলত বাংলাদেশি পাটপণ্য রপ্তানির প্রবাহ কমিয়ে আনার একটি কৌশল, যা দীর্ঘমেয়াদে পাটশিল্পের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের পাটশিল্প দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের বার্ষিক রপ্তানির বড় অংশই ভারতে যায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বিহারের শিল্পকারখানাগুলোতে। এই নতুন বিধিনিষেধ কার্যকর হলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য রপ্তানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে।
এ ছাড়া সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এতে ভারতীয় ক্রেতারা বিকল্প উৎস খোঁজা শুরু করলে বাংলাদেশের বাজার হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়া নেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য চরম অস্বস্তিকর। একজন অভিজ্ঞ পাটপণ্য রপ্তানিকারক বলেন, “আমাদের বড় অংশের ব্যবসা নির্ভর করে স্থলপথে দ্রুত ও কম খরচে পণ্য পৌঁছানোর ওপর। এখন যদি বাধ্য হয়ে সমুদ্রপথ ব্যবহার করতে হয়, তাহলে খরচ দ্বিগুণেরও বেশি হবে এবং অর্ডার ডেলিভারি সময়ও অনেক বেড়ে যাবে।”
তারা আরও মনে করছেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের পাটশিল্পে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে।
ভারত অতীতে বাংলাদেশের কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর বিভিন্ন সময় অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে স্থলপথে রপ্তানির ওপর ধারাবাহিক বিধিনিষেধ আরোপ সেই নীতির অংশ বলেই মনে করছেন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উভয় কারণেই হতে পারে, যা এখনই সমাধানের উদ্যোগ না নিলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে টানাপোড়েন আরও বাড়াবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে আলোচনার ফল আসতে সময় লাগতে পারে, আর ততদিনে পাটপণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ