
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)–তে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিশনের মুলতবি সভায় এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান।
এই সংশোধনীগুলোর মধ্যে রয়েছে—একক প্রার্থী থাকলে ব্যালটে ‘না ভোট’-এর বিধান যুক্ত করা, পুরো আসনের ভোট বাতিল করার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার, হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে এমপি পদ বাতিলের বিধান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী ও কোস্ট গার্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা, নির্বাচন কর্মকর্তা অপরাধ করলে কঠোর শাস্তির বিধান, জোটভুক্ত দলের প্রার্থীদের নিজ নিজ প্রতীকে ভোটের বাধ্যবাধকতা, সমান ভোট পেলে লটারি পদ্ধতি বাতিল করে পুনঃভোটের ব্যবস্থা, ইভিএম-সংক্রান্ত সব বিধান বিলুপ্তকরণ, রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত হলে নিবন্ধনও স্থগিত করার বিধানসহ আরও নানা পরিবর্তন।
একক প্রার্থীর আসনে ‘না ভোট’ বাধ্যতামূলক
কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, একক প্রার্থী থাকলে সেই প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে ব্যালটে ‘না ভোট’ যুক্ত থাকবে। অর্থাৎ, যদি কোনো আসনে মাত্র একজন প্রার্থী মনোনীত হন, ভোটাররা চাইলে তার বিপক্ষে ‘না ভোট’ দিতে পারবেন। যদি ‘না ভোট’ প্রাপ্তি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তবে প্রার্থী নির্বাচিত হবেন না।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে সব আসনেই ‘না ভোট’ ছিল, তবে এবার তা কেবল একক প্রার্থীর আসনে প্রযোজ্য হবে। এই বিধান যুক্ত হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথ রুদ্ধ হবে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ফিরছে
ইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনো আসনে যদি ভোটগ্রহণে গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়ে, তাহলে নির্বাচন কমিশন পুরো আসনের ভোট স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে। অতীতে এই ক্ষমতা সীমিত করা হলেও এবার তা পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে। সানাউল্লাহ বলেন, “প্রয়োজন মনে করলে কমিশন এক বা একাধিক আসনের ফলাফল বাতিল করতে পারবে।”
হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে এমপি পদ হারানোর ঝুঁকি
সংশোধনীতে স্পষ্ট করা হয়েছে, যদি কোনো প্রার্থী নির্বাচনী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন এবং পাঁচ বছরের মেয়াদকালে তা প্রমাণিত হয়, তাহলে তার প্রার্থিতা বাতিলের পাশাপাশি এমপি পদও হারাতে হবে। তবে পাঁচ বছরের পর এই ক্ষমতা ইসির আওতায় থাকবে না। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ, বিমান ও কোস্ট গার্ড
পূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সরাসরি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এবার এই সংজ্ঞায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কোস্ট গার্ডও যুক্ত হচ্ছে। তবে বিএনসিসিকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
নির্বাচন কর্মকর্তাদের অপরাধে দ্রুত ব্যবস্থা
নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কোনো কর্মকর্তা গুরুতর অনিয়ম বা অবহেলা করলে তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে এই ব্যবস্থা নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে এবং তদন্তের ফলাফল ইসিকে জানাতে হবে। একইসঙ্গে কর্মকর্তার বার্ষিক গোপন প্রতিবেদনে (এসিআর) এ অপরাধের উল্লেখ থাকবে।
লটারির পরিবর্তে পুনঃভোট
এখন পর্যন্ত সমান ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে বিজয়ী নির্ধারণে লটারির বিধান ছিল। কমিশন মনে করছে, এটি গণতান্ত্রিক নয়। তাই নতুন বিধানে লটারির পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট আসনে পুনঃনির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ইভিএম বাতিল
ইসির আগের সিদ্ধান্ত অনুসারে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে না। তাই আরপিও থেকে ইভিএম-সংক্রান্ত সব প্রভিশন বিলুপ্ত করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত হলে নিবন্ধনও স্থগিত
সংশোধনীতে নতুন বিধান হিসেবে যুক্ত হয়েছে—যদি কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম স্থগিত হয়, তবে ইসি চাইলে সেই দলের নিবন্ধনও স্থগিত করতে পারবে।
জোটভুক্ত প্রার্থীর নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন
একাধিক দল মিলে জোট গঠন করে নির্বাচন করলে প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে—এমন বাধ্যবাধকতা যুক্ত হচ্ছে। এর ফলে জোটের একক প্রতীকের পরিবর্তে প্রতিটি দলের পরিচিত প্রতীকই ব্যালটে থাকবে।
ভোট গণনায় সাংবাদিকদের উপস্থিতি
ভোট গণনার সময় সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকতে পারবেন, তবে মাঝপথে গণনার কক্ষ থেকে বের হতে পারবেন না। এ ছাড়া বিলবোর্ডে আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ করা হলেও ডিজিটাল বিলবোর্ডে আলোর ব্যবহার চালু থাকবে।
প্রার্থীর ব্যয় অডিট ও অনুদানের সীমা বৃদ্ধি
নির্বাচনী ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট অডিটের বিধান যুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা (আগে ১০ লাখ) এবং প্রতিষ্ঠান পর্যায় থেকেও ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান নিতে পারবে। শর্ত হচ্ছে, সব লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে হতে হবে এবং অনুদানদাতার কর রিটার্নে এ তথ্য প্রদর্শন করতে হবে।
ভুয়া তথ্য ও অপপ্রচারে ব্যবস্থা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে বা অন্য যেকোনো উপায়ে মিথ্যাচার, অপবাদ বা বিভ্রান্তি ছড়ালে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী, রাজনৈতিক দল, সংস্থা বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রভিশন রাখা হয়েছে।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও কর্মপরিকল্পনা
সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়ায় ৮২টি আসনের বিরুদ্ধে আপত্তি এসেছে। এসব বিষয়ে শুনানি হবে। এ ছাড়া আগামী ১৮ আগস্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপনের জন্য ইসি সচিবালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সংশোধনীগুলোর খসড়া সপ্তাহের মধ্যেই চূড়ান্ত করে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। এর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রস্তুতির প্রক্রিয়া আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ