
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বহুল আলোচিত এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাশিত বাণিজ্যচুক্তি শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে এই ঐতিহাসিক চুক্তি এখন কেবল দুই দেশের শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানদের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
বুধবার (১১ জুন) নিজের ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ এক পোস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তির বিষয়টি ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি প্রথমে প্রচার করে।
পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, “চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পাবে ৫৫ শতাংশ শুল্ক সুবিধা, আর চীন পাবে ১০ শতাংশ। এর মাধ্যমে আমাদের পণ্যের রফতানি আরও সহজ হবে এবং দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি সুবিধা পাবে।” তিনি আরও বলেন, “চীন আগাম ভিত্তিতে আমাদের দেশে পূর্ণমাত্রায় ম্যাগনেট এবং প্রয়োজনীয় বিরল খনিজ (rare earth minerals) সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে।”
বিশ্বব্যাপী আধুনিক প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে চাহিদাসম্পন্ন এই বিরল খনিজ উপাদানের বিষয়ে চীনের ওপর বিশ্ব বাজারের নির্ভরতা অত্যন্ত বেশি। তাই এই চুক্তিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া বড় অগ্রগতি বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও লেখেন, “চীনকেও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুবিধা দেবে। এর মধ্যে রয়েছে চীনা শিক্ষার্থীদের মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবহারের সুযোগ, যা আমার সবসময়ই ভালো লেগেছে। আমি চাই চীনের মেধাবী তরুণরা আমাদের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করুক, এতে দু'দেশই উপকৃত হবে।”
তিনি এ সময় দুই দেশের সম্পর্ককে “দারুণ” বলে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন, “বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সমঝোতার মাধ্যমে আগাচ্ছি।”
সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টের পর সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন ট্রাম্প। তিনি জানান, “চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চাই, যাতে চীনের বাজার আরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়। এটা দু'দেশেরই বিজয় হবে।”
ট্রাম্প বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ নয়—বরং একটি যৌক্তিক, স্বচ্ছ ও পারস্পরিক লাভজনক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। এই চুক্তির মাধ্যমে সেই পথ অনেকটাই সুগম হয়েছে।”
উল্লেখ্য, ২০২5 সালের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা নতুন করে চরমে পৌঁছায়, যখন যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর নতুন করে বড় ধরনের শুল্ক আরোপ শুরু করে। এপ্রিলে কার্যকর হওয়া সেই শুল্ক ব্যবস্থার আওতায় চীনের প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স ও খনিজভিত্তিক পণ্যে গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানো হয়।
তবে আন্তর্জাতিক চাপে এবং বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এড়াতে, মে মাসে দুই দেশ প্রাথমিকভাবে ৯০ দিনের জন্য এই শুল্ক ব্যবস্থা আংশিকভাবে প্রত্যাহারে সম্মত হয়। এরপর চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লন্ডনে এক গোপনীয় বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকেই মূলত এই সমঝোতামূলক চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয় বলে জানিয়েছে একটি কূটনৈতিক সূত্র।
এই চুক্তিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ‘গ্লোবাল ইকোনমিক রি-ব্যালান্সিং’-এর সূচনা হিসেবে দেখছেন। দীর্ঘমেয়াদি শুল্ক যুদ্ধ, প্রযুক্তি হস্তান্তরবিষয়ক বিতর্ক, ও সামরিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এমন এক চুক্তি দুই দেশের সম্পর্ক নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
বিশ্ব বাণিজ্যে দুই দেশের অংশগ্রহণ বিবেচনায়, এই চুক্তির প্রতিফলন হতে পারে বৈশ্বিক বাজারেও। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং এটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভারসাম্যের দিক থেকে একটি ‘পজিটিভ টার্ন’ বলে অভিহিত করেছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি চূড়ান্ত সমাধান নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি সমঝোতার এক প্রাথমিক ধাপ। চুক্তির সফল বাস্তবায়নের জন্য দুই দেশের পারস্পরিক আস্থা ও নিষ্ঠার পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছাও জরুরি। বিশেষ করে প্রযুক্তি, সেন্সিটিভ ডেটা, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভবিষ্যতে আরও পৃথক আলোচনা প্রয়োজন হতে পারে।
এখন শুধু ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেলেই এই চুক্তি কার্যকর হবে। বিশ্ববাসী তাকিয়ে আছে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির দিকে, যা হয়তো আগামী কয়েক বছরের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ