
ছবি: সংগৃহীত
গত ১৩ জুন থেকে ইরান-ইসরাইল সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়ানোর পর প্রথমবারের মতো নিহত ও আহতের নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তেহরান। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে দেশটির সরকারি ঘরানার সংবাদ সংস্থা নূর নিউজ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ইরানে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৩০ জন এবং আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ জন। রাজধানী তেহরানসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নগর ও সামরিক স্থাপনায় হামলার ফলে হতাহতের সংখ্যা এতো বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত এই পরিসংখ্যানই ইরানের পক্ষ থেকে সংঘাত-পরবর্তী সবচেয়ে বড় সরকারি স্বীকারোক্তি। এর আগে গত রোববার (১৫ জুন) ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যে বলা হয়েছিল, সংঘাতে নিহত হয়েছেন ২২৪ জন। কিন্তু এই সর্বশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, হতাহতের সংখ্যা আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে।
এদিকে, মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস নিউজ এজেন্সি (HRANA) শুক্রবার এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ইরানজুড়ে সাম্প্রতিক ইসরাইলি বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহতের সংখ্যা ৬৫৭ জন ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এই সংখ্যাটি ইরান সরকার এখনও স্বীকার করেনি।
উল্লেখ্য, ১৩ জুন ভোররাতে ইসরাইল আকস্মিকভাবে ইরানের অভ্যন্তরে ব্যাপক সামরিক হামলা চালায়। মূলত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে—এমন অভিযোগ তুলে হামলার ঘোষণা দেয় তেলআবিব। তবে তেহরান ইসরাইলের এই দাবি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।
ইসরাইলি বাহিনীর এই হামলায় ইরানের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি, বিমান ঘাঁটি, রাডার কেন্দ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ কিছু আবাসিক এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ইস্পাহান, কারাজ, খুজেস্তান ও কেরমানশাহ প্রদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
এই হামলার জবাবে ইরানও পাল্টা সামরিক পদক্ষেপ নেয়। ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে ইরান লক্ষ্যবস্তু করে ইসরাইলের তেলআবিব, হাইফা ও বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর এলাকার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (IDF) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইরান থেকে আসা শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্রের বেশির ভাগই আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে, তবে কিছু হামলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইসরাইলের মতে, ইরানে চালানো হামলার জবাবে ইরানের আঘাতে তাদের দেশে ২৫ জন নিহত হয়েছে এবং ২ হাজার ৫১৭ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।
ইসরাইল জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ ছিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, যা ইরান থেকে উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র সতর্কতায় আতঙ্কের মধ্যেই ঘটে।
ইসরাইলি মিডিয়ার তথ্যমতে, এই হামলার ফলে উত্তর ইসরাইলে কিছু সামরিক স্থাপনা ও একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, "যে কোনো ধরনের হুমকির জবাবে ইসরাইল কঠোরতম প্রতিক্রিয়া জানাবে।"
অন্যদিকে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এক টেলিভিশন ভাষণে বলেন, “ইসরাইলের আগ্রাসন আমাদের প্রতিরোধের মনোভাবকে আরও জোরালো করেছে। ইরানের জনগণের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন এবং তুরস্কসহ একাধিক দেশ এ সংঘর্ষ থামাতে আহ্বান জানিয়েছে এবং উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর অনুরোধ করেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “এই সংঘাত বিস্তৃত হলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জ্বলন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”
এই মুহূর্তে ইরান ও ইসরাইল উভয়ই যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরমাণু কর্মসূচি ও আঞ্চলিক আধিপত্যকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা কয়েক দশক ধরে চলছিল, তা এবার খোলামেলা সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে—এবং তার পরিণতি অনিশ্চিত ও ভয়াবহ হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ