
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শুধু একাডেমিক সাফল্য, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিংবা প্রগতিশীল আন্দোলনের ভাণ্ডারেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ— ডাকসু— দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির জন্য এক পরীক্ষাগার, যেখানে গড়ে উঠেছে দেশের অগ্রগামী নেতৃত্ব। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম কিংবা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই— প্রতিটি বাঁকে ডাকসুর ভূমিকা ছিল কেন্দ্রীয়, আর এখান থেকেই উঠে এসেছে দেশের বহু খ্যাতনামা জাতীয় নেতা।
সূচনালগ্নে ডাকসু: ১৯২৪ সালে প্রথম নেতৃত্ব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছর পরেই ১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ। প্রথম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। এর পরের বছর মমতাজউদ্দিন আহমেদ সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং এ কে মুখার্জী সাধারণ সম্পাদক (জিএস) হিসেবে দায়িত্ব পান। তখনো এই সংগঠনের নাম ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ।
ডাকসুর জন্ম ও নতুন পরিচিতি
১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে এ ছাত্র সংসদের নামকরণ করা হয় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ” বা ডাকসু। এটি শুধু নামের পরিবর্তনই নয়, কার্যক্রমেরও বিস্তার ঘটায়। শুরুর পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীদের সমস্যা-সমাধানকেই প্রাধান্য দেওয়া হলেও, ষাটের দশক থেকে ডাকসু হয়ে ওঠে জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্ব সৃষ্টির অন্যতম উৎস।
ষাটের দশকের উত্তাল সময়: ডাকসুর উত্থান
ষাটের দশক ছিল পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক জাগরণের সময়। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল ছিল দেশ। এই সময়ে ডাকসু নেতৃত্বে আসেন এমন কয়েকজন ছাত্রনেতা, যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
-
১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষে ভিপি হন শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ, জিএস হন কে এম ওবায়দুর রহমান (পরে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী)।
-
১৯৬৩-৬৪ সালে নেতৃত্ব পান রাশেদ খান মেনন (পরে বাম রাজনীতির অন্যতম মুখ) এবং অগ্নিকন্যা খ্যাত মতিয়া চৌধুরী (পরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী)।
-
১৯৬৪-৬৫ সালে ডাকসুর ভিপি ছিলেন বোরহানউদ্দিন, জিএস আসাফুদ্দৌলা।
-
১৯৬৬-৬৭ সালে ভিপি হন ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী (পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে বিশিষ্ট নেতা), আর জিএস ছিলেন শফি আহমেদ।
-
১৯৬৭-৬৮ সালে মাহফুজা খান দ্বিতীয় নারী ভিপি নির্বাচিত হন, আর জিএস ছিলেন মোরশেদ আলী।
-
১৯৬৮-৬৯ সালে নির্বাচিত হন তোফায়েল আহমেদ (পরে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, মন্ত্রী), জিএস ছিলেন নাজিম কামরান চৌধুরী।
-
১৯৭০-৭১ সালে নেতৃত্বে আসেন আ স ম আবদুর রব (স্বাধীনতার ডাক দেওয়া ছাত্রনেতা) এবং আব্দুস কুদ্দুস মাখন।
এই সময়ের ডাকসু শুধু ছাত্রদের প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান ছিল না, বরং স্বাধিকার আন্দোলনকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ডাকসু
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ডাকসুর ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (পরবর্তীতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি) এবং জিএস হন মাহবুব জামান। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়, এরপর দীর্ঘ সময় আর ডাকসুতে ভোট হয়নি।
আশির দশকের নতুন প্রজন্ম
দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভিপি হন মাহমুদুর রহমান মান্না (পরে নাগরিক রাজনীতির আলোচিত নেতা), জিএস হন আখতারুজ্জামান। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে আবারও আখতারুজ্জামান জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে তিনি ভিপি নির্বাচিত হন, আর জিএস হন জিয়াউদ্দিন বাবলু (পরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও মন্ত্রী)।
১৯৮৯-৯০ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচনে ডাকসুর নেতৃত্বে আসেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ (পরে জাতীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী) ও মুশতাক হোসেন।
১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে নির্বাচিত হন আমানউল্লাহ আমান (পরে বিএনপির শীর্ষ নেতা, সংসদ সদস্য) এবং খায়রুল কবির খোকন।
এরশাদ পতনের পর স্থবিরতা
এরশাদ পতনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেও ডাকসু কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। নানা রাজনৈতিক জটিলতা, প্রশাসনিক অনাগ্রহ এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবের কারণে তিন দশকের বেশি সময় নির্বাচন হয়নি।
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন
প্রায় ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে আবারও অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। যদিও ছাত্রলীগ অধিকাংশ পদে জয়ী হয়, তবে সবার বিস্ময় কাটিয়ে ভিপি নির্বাচিত হন কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। জিএস নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানী এবং এজিএস হন সাদ্দাম হোসেন। এই নির্বাচনও বিতর্ক, সংঘর্ষ এবং কারচুপির অভিযোগে আলোচিত হয়েছিল।
২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন
প্রায় ছয় বছরের বিরতির পর আবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নিষিদ্ধ হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, ফলে তাদের অংশগ্রহণ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই নির্বাচন। তবুও অন্তত ১০টি প্যানেল অংশ নিচ্ছে, পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও মাঠে রয়েছে।
ভোটগ্রহণ চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি কেন্দ্রে ৮১০টি বুথে। মোট ভোটার সংখ্যা ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন, যার মধ্যে ছাত্রী ১৮ হাজার ৯৫৯ এবং ছাত্র ২০ হাজার ৯১৫ জন। ডাকসুর ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী, আর ১৮টি হল সংসদের ২৩৪টি পদে লড়ছেন আরও ১,০৩৫ জন প্রার্থী। প্রতিটি ভোটারকে দিতে হচ্ছে ৪১টি ভোট, যার জন্য ব্যালটপেপার পাঁচ পৃষ্ঠায় সাজানো হয়েছে।
ডাকসুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ডাকসুকে ইতিহাসবিদরা বাংলাদেশের “দ্বিতীয় সংসদ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, এই সংসদ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানায় সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জাতীয় রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এখান থেকে উঠে আসা নেতৃত্বেরাই পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ, মন্ত্রিসভা কিংবা বিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
ডাকসুর ইতিহাস তাই কেবল ক্যাম্পাসের নির্বাচনী ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে গণতন্ত্রের সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি বাঁকে ডাকসু ছিল ছাত্র সমাজের কণ্ঠস্বর— আর সেই কণ্ঠস্বর আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নেতৃত্ব সৃষ্টির অঙ্গীকার বহন করে চলেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ