
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর আবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ চলছে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ভোর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কেন্দ্র ও হল প্রাঙ্গণে ভোটারদের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। লাইনে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করছেন তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য। ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে— বিকেল ৪টার আগে যে কেউ লাইনে ঢুকতে পারলে তিনিও ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
উৎসবমুখর পরিবেশে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান
ডাকসু নির্বাচন দীর্ঘ সময় ধরে না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের প্রত্যাশা ও আগ্রহ জমে উঠেছিল। এবার নির্বাচনের দিন সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে। রাজনৈতিক অঙ্গন ও জাতীয় পর্যায়ের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে অংশ নিতে শিক্ষার্থীরা সকাল থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে উৎসবমুখর আমেজ। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ নির্বাচন শুধুমাত্র নেতৃত্ব বাছাইয়ের জন্য নয়; বরং ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
বিপুল সংখ্যক ভোটার ও প্রার্থীর অংশগ্রহণ
বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের ডাকসুতে মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ১৮ হাজার ৯৫৯ জন এবং ছাত্র ২০ হাজার ৯১৫ জন। প্রার্থী হয়েছেন মোট ৪৭১ জন, যারা ২৮টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। পাশাপাশি ১৮টি হল সংসদ নির্বাচনে ২৩৪টি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৩৫ জন প্রার্থী। ফলে প্রতিটি ভোটারকে ডাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে ৪১টি ভোট দিতে হবে, যার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট।
ব্যালট পাঁচ পৃষ্ঠার, ভোট দেওয়ার নতুন অভিজ্ঞতা
শিক্ষার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য এবার ব্যালট রাখা হয়েছে পাঁচ পৃষ্ঠার। ফলে অনেকের জন্য এটি এক নতুন অভিজ্ঞতা। ভোট দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্দেশনা দিয়েছে। এছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রথমবারের মতো ব্রেইল পদ্ধতিতে ভোটদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাদের ব্রেইল পড়ার দক্ষতা নেই, তারা চাইলে অন্য কারও সহযোগিতা নিতে পারবেন।
বুথ সংখ্যা বাড়ানো, ভোটারদের ভোগান্তি কমাতে উদ্যোগ
প্রথমে ৮ কেন্দ্রে ৭১০টি বুথ রাখা হলেও শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা ভেবে পরে সেটি বাড়িয়ে ৮১০ বুথে উন্নীত করা হয়েছে। প্রশাসন বলছে, এর ফলে আবাসিক ও অনাবাসিক ভোটাররা দ্রুত ভোট দিতে পারবেন, লাইনে দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত ভোগান্তি পোহাতে হবে না। তবে শিক্ষার্থীদের লম্বা লাইন এবং উদ্দীপনাই প্রমাণ করে যে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহী।
১০টি প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা
এবারের ডাকসু নির্বাচনে রয়েছে অন্তত ১০টি প্যানেল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), সাতটি বাম সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’, ছাত্রশিবির মনোনীত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ এবং ইসলামী ছাত্র আন্দোলন।
এছাড়া তিনটি সংগঠন— ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের একাংশ ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল-বাংলাদেশ জাসদ)— একত্র হয়ে গঠন করেছে ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ প্যানেল। প্রতিটি প্যানেলই ভিপি, জিএস ও এজিএসসহ বিভিন্ন পদে নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও লড়ছেন নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষায়।
গুরুত্বপূর্ণ পদে আলোচিত প্রার্থীরা
ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রার্থীরা। ছাত্রদলের মনোনীত ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান, জিএস পদে শেখ তানভীর বারী হামিম, আর এজিএস পদে তানভীর আল হাদী মায়েদ।
অন্যদিকে ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমানে কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক আবু সাদিক কায়েম। জিএস পদে আছেন এস এম ফরহাদ এবং এজিএস পদে মুহাঃ মহিউদ্দীন খান।
বাগছাস থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আব্দুল কাদের, এজিএস পদে আবু বাকের মজমুদার এবং আশরেফা খাতুন। সাত বাম সংগঠনের ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে ভিপি পদে প্রার্থী হয়েছেন শেখ তাসনীম আফরোজ ইমি, জিএস পদে মেঘমল্লার বসু এবং এজিএস পদে জাবির আহমেদ জুবেল। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উমামা ফাতেমা, যেখানে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আল সাদী ভূঁইয়া এবং এজিএস পদে জাহেদ আহমদ। ছাত্র অধিকার পরিষদের ভিপি পদে আছেন সংগঠনের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, জিএস পদে সাবিনা ইয়াসমিন এবং এজিএস পদে রাকিবুল ইসলাম। ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ থেকে ভিপি পদে লড়ছেন নাইম হাসান হৃদয়, জিএস পদে এনামুল হাসান অনয় এবং এজিএস পদে অদিতি ইসলাম।
নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, দীর্ঘ বিরতির পর ডাকসু নির্বাচন তাদের জন্য নতুন নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা আশা করছেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শুধু রাজনৈতিক দলীয় স্বার্থ নয়, বরং শিক্ষার্থীদের প্রকৃত স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় কাজ করবেন।
ভোটকেন্দ্রে দেখা গেছে নারী ভোটারদেরও সমান উৎসাহ। আবাসিক ছাত্রীদের পাশাপাশি অনাবাসিক অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিচ্ছেন।
সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন আছে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, এ নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র চর্চার একটি নতুন অধ্যায় উন্মোচন করবে। ডাকসু শুধু নেতৃত্ব গড়ে তোলে না, দেশের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই শিক্ষার্থীরা চায় এই নির্বাচন ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক উদাহরণ হয়ে উঠুক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ