
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাস এখন এক উৎসবমুখর পরিবেশে জমে উঠেছে। মনোনয়নপত্র জমা ও প্যানেল ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা সরব হয়ে উঠেছেন। এবারের নির্বাচনে বিশেষভাবে নজর কাড়ছে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ। ইতিহাসের অন্যতম বড় উপস্থিতি হিসেবে এবার প্রায় ৬০ জন নারী শিক্ষার্থী প্রার্থী হয়েছেন, যার মধ্যে ভিপি পদে একাই লড়ছেন ৫ জন। পাশাপাশি জিএস, এজিএসসহ বিভিন্ন পদেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অনেকে।
নারী প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা নির্বাচিত হলে সবার আগে নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তুলবেন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা আসার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুলিং ও নানা ধরনের ট্রলিংয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন অনেকে। তবুও তারা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন—নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে তাদের অন্যতম লক্ষ্য।
ভিপি পদে লড়াই করা স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক ক্যাম্পাসে রূপান্তরিত করাই আমার লক্ষ্য। শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, আবাসন সমস্যা সমাধান এবং পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা হবে আমার অঙ্গীকার।” তিনি আরও বলেন, নারী প্রার্থী হিসেবে অনলাইন হ্যারেজমেন্ট অবশ্যই বড় একটি চ্যালেঞ্জ, তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগই তাদের শক্তি।
অন্যদিকে ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ প্যানেল থেকে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি জানান, “আমি আন্দোলনের ময়দানে ছিলাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় কথা বলেছি। এখন সেই অভিজ্ঞতাই আমাকে শক্তি দিচ্ছে। জিতলে প্রথমেই ক্যাম্পাসকে নিরাপদ করব এবং আবাসন সংকট দূর করব।” তার মতে, প্রার্থীদের পারসোনাল ট্র্যাক রেকর্ডই শিক্ষার্থীরা গুরুত্ব দেবে।
এজিএস পদে সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থী ফাতেমা শারমিন এ্যানি বলেন, “আমি নারী বলে অযোগ্য নই। বরং হলে থেকে ছাত্রীদের সমস্যাগুলো কাছ থেকে জানি। গণরুমের বিরুদ্ধে আমি বহুদিন ধরেই আন্দোলন করেছি। জিতলে ছেলে-মেয়েদের সব সমস্যা সমানভাবে সমাধান করার চেষ্টা করব।”
নারী প্রার্থীদের অধিকাংশই অনলাইন বুলিংয়ের অভিযোগ করেছেন। তাদের মতে, ছাত্র সংগঠনগুলোর মতো সাংগঠনিক শক্তি না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। তবে তারা বলছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সরাসরি সংস্পর্শে থাকার কারণে তাদের সমর্থনও দ্রুত বাড়ছে।
প্রার্থীরা এখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময়ে ব্যস্ত। শুক্রবার ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন, ছবি তুলছেন, ছোট ছোট সভা করছেন। আবার বিকেলে বিভিন্ন প্যানেল সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ইশতেহার তুলে ধরেছে।
এদিকে ভোটকেন্দ্রের দূরত্ব নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। উমামা ফাতেমা দাবি জানিয়েছেন, ছাত্রীদের ভোটকেন্দ্র যেন তাদের হলের কাছাকাছি স্থাপন করা হয়। তিনি বলেন, “দূরত্বের কারণে ভোটদানে অনেকেই নিরুৎসাহিত হতে পারেন। তাই সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট ও পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটে ভোটকেন্দ্র করার দাবি জানাচ্ছি।”
আরেক প্রার্থী নুসরাত জাহান নিসু প্রশাসনের কাছে দাবি করেছেন, ক্যাম্পাসে সাইবার সেল গঠন করতে হবে, যাতে নারী শিক্ষার্থীরা অনলাইন হ্যারেজমেন্ট থেকে রক্ষা পান। এছাড়া বাস ট্রিপ বাড়ানো ও নিরাপত্তা জোরদার করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।
ছাত্রশিবিরের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তারা নির্বাচিত হলে নারী শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট সমাধান করবেন। একই সঙ্গে ডে-কেয়ার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, আধুনিক রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এবং বাস সিন্ডিকেটের অবসান ঘটাবেন। তার মতে, “ছাত্রীদের শতভাগ আবাসন নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নৈতিক দায়িত্ব।”
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের অভিযোগ করেন, ইচ্ছাকৃতভাবে নারী শিক্ষার্থীদের ভোট থেকে দূরে রাখতে কেন্দ্রগুলো দূরে রাখা হয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, “আমরা নির্বাচিত হলে ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান সিট নীতি বাস্তবায়ন করব এবং গণরুম-গেস্টরুম প্রথা চিরতরে বন্ধ করব।”
দলটির জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার আরও যোগ করেন, তারা হলে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা চালু করবেন। এমনকি স্টারলিংক সেবা আনার পরিকল্পনাও তাদের ইশতেহারে রয়েছে।
ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণামূলক বিলবোর্ড ও ব্যানার টানানোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যেসব ব্যানার টানানো হয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে সরাতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে ডাকসু নির্বাচন সবসময়ই বড় প্রত্যাশার জায়গা। এবারের নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। নিরাপদ ক্যাম্পাস, আবাসন সংকট সমাধান, শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ ও সাইবার সুরক্ষা—সবকিছু মিলিয়ে নারী প্রার্থীদের এজেন্ডা শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুলিং, ভোটকেন্দ্র বিতর্ক ও প্রচারণা নিয়ে টানাপোড়েন প্রমাণ করছে, সামনে এক কঠিন কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ লড়াই অপেক্ষা করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ