
ছবি: সংগৃহীত
ব্যাংক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও বিগত দেড় দশকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে এই খাতটি হয়ে পড়েছে দুর্নীতির অভয়ারণ্য। ঋণের নামে লুটপাট, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ মওকুফ, জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তুলে বিদেশে পাচার এবং খেলাপির সংস্কৃতির বিকাশ—সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত এখন এক ভয়াবহ সংকটের সম্মুখীন। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং বিভিন্ন ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি কাগজে-কলমে থাকা পরিসংখ্যান, প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। প্রবৃদ্ধির এই ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করে তুলবে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে এমন দুর্নীতি, এমন লুটপাট হয়েছে যা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, বিশ্বের জন্যও একটি ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত। ব্যাংক খাতকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় এর স্বাভাবিক প্রবাহ এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতের মোট সম্পদ কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ২৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা, যেখানে গত বছরের একই সময়ে সম্পদ ছিল প্রায় ২৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে অকার্যকর সম্পদের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কারণ লুটপাট ও পাচার করা অর্থ ফেরত না আসায় এবং নতুন কোনো উৎপাদনশীল বিনিয়োগ না হওয়ায় এসব সম্পদ এখন মূলত মৃত পুঁজি হয়ে আছে।
ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় দুটি আয় উৎস—সম্পদ থেকে আয় এবং মূলধন বিনিয়োগ থেকে আয়—দুই দিক থেকেই কমতির ধারা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সম্পদ থেকে ব্যাংকগুলোর আয় ছিল ১০০ টাকায় মাত্র ৫৯ পয়সা, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছে ৩৪ পয়সায়। একইভাবে মূলধন বিনিয়োগ থেকে আয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১০ টাকা ৭০ পয়সা, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কমে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৪২ পয়সা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও বিমা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক বলেন, “বিনিয়োগ থেকে আয় না বাড়লে ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা কঠিন। তারা মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না, প্রভিশন ঘাটতি বাড়বে। এখন ঠিক সেটাই ঘটছে।”
ব্যাংক খাতের আয়ের এই হ্রাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১টি ব্যাংক, যারা জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সম্পদ থেকে কোনো আয়ই করতে পারেনি। আরও ২০টি ব্যাংক আয় করেছে মাত্র ৫ শতাংশের নিচে। ১০ শতাংশের বেশি আয় করতে পেরেছে মাত্র ২০টি ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণের হার ছিল ৮৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৬৯ দশমিক ৫০ শতাংশে এবং একই বছরের ডিসেম্বরে ৬৫ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে সেটি ব্যাংকের মূলধনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে ব্যাংকগুলোর অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। যেসব ব্যাংক আগে থেকেই দুর্বল, তাদের জন্য এটি মৃত্যুঘণ্টা হয়ে উঠতে পারে।”
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার ছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ, যা গত সেপ্টেম্বরে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ১৩ শতাংশে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এ হার হওয়া উচিত অন্তত ১০ শতাংশ। এভাবে মূলধন ঘাটতি ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় কয়েকটি ব্যাংক এখন তীব্র সংকটে পড়েছে, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা নতুন প্রাইভেট ব্যাংকগুলো।
বর্তমানে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৮২ শতাংশই কু-ঋণে পরিণত হয়েছে, যেগুলো আদায় প্রায় অসম্ভব। এসব ঋণের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের সময় দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের, ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের এবং ঘুষ দিয়ে ঋণ নেয়া ভুয়া কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আব্দুল হক বলেন, “ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে মানুষ আমানত রাখতেও ভয় পাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করছেন। অথচ অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে একটি কার্যকর ব্যাংক ব্যবস্থা অপরিহার্য।”
ব্যাংক খাত নিয়ে গত এক দশকে যেসব নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই রাজনীতিকরণ ও ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত। খেলাপিদের জন্য একের পর এক ছাড়, ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা, সম্পদের রিক্লাসিফিকেশনে জটিলতা ইত্যাদি সিদ্ধান্ত বাস্তবিক অর্থে ব্যাংক খাতকে আরও দুর্বল করে তুলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্তে একদিকে যেমন খেলাপির সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি আমানতকারীদের আস্থা কমেছে। যা ব্যাংক খাতের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে বাধা।”
বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করছে, তারা বর্তমানে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য বিভিন্ন সংস্কারমুলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। টাকা পাচার বন্ধে নেওয়া হয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি। ফলে কিছুটা করে আমানত প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রয়াসগুলো যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হয়, তবে ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা কাটানো সম্ভব নয়।
সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, “সংস্কার কার্যক্রম ভালো, তবে তা রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নিলে জনগণের আস্থা ফিরবে না।”
ব্যাংক খাতের বর্তমান বিপর্যয়ের পেছনে প্রধান দায় রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও ধারাবাহিক দুর্নীতির সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে ওঠা লুটপাটভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এখন যদি কার্যকর সংস্কার, কঠোর আইনি ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয় না হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড এই খাতটি পুরোপুরি দেউলিয়া হয়ে পড়বে—এতে কোনো সন্দেহ নেই।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর তাই এখন দারুণ এক দায়িত্ব—ব্যবস্থাপনাগত এবং রাজনৈতিকভাবে মুক্ত একটি ব্যাংকিং খাত গড়ে তোলা, যা দেশের অর্থনীতিকে পুনরায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে। না হলে, আগামী প্রজন্মকে উত্তরাধিকার হিসেবে দিতে হবে একটি পরিত্যক্ত ব্যাংকিং কাঠামো, যেখানে আস্থা থাকবে না, থাকবে শুধু ঋণ আর লাল সংকেত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ