
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ বর্তমানে এশিয়ার সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের দেশ হিসেবে পরিচিত। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) ২০২৫ সালের সাম্প্রতিক ‘ননপারফর্মিং লোনস ওয়াচ ইন এশিয়া’ প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে বিতরণ করা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। অর্থাৎ দেশের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
খেলাপি ঋণের প্রবণতা ও ইতিহাস
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের সমস্যা নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে দেশে ঋণ প্রদানের নিয়মকানুন শিথিল রাখা হয়েছে, বিশেষ করে বড় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। ২০২০ সালে দেশের খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭.৭ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৯ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালে এই হার আরও বৃদ্ধি পেয়ে ২০.২ শতাংশে পৌঁছেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দীর্ঘদিনের শিথিল নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতা এই পরিস্থিতির মূল কারণ। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “আগের সরকার ঋণের শর্ত শিথিল করেছিল। বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করা হতো যেন সব ঠিকঠাক দেখায়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে। নিয়ম যত কঠোর হবে, খেলাপি ঋণ প্রকাশের সংখ্যা তত বাড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “ভারতও একসময় খেলাপি ঋণের সমস্যায় ভুগছিল। কিন্তু তারা কঠোর নিয়ম, কার্যকর ব্যাংক সংস্কার এবং রাজনীতির হস্তক্ষেপ কমিয়ে সমস্যার সমাধান করেছে। বাংলাদেশকেও একইভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা
এডিবি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ঋণ দেওয়ার নিয়মাবলি দুর্বল এবং খেলাপি ঋণ আদায় ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। দেশের অনেক বড় ব্যাংক এখনও ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আড়াল করে। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ঋণ পুনর্গঠন করা হয়ে থাকে, যা প্রকৃত খেলাপি চিত্রকে অস্পষ্ট করে তোলে।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আসার পর কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায়ে পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। আইন শক্তিশালী করা, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং বাজারে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “বিগত বছরের মতো যদি বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে যায় বা দুর্নীতির মামলায় জড়িত হয়, তবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।”
এশিয়ার তুলনামূলক চিত্র
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল খেলাপি ঋণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ভারত তাদের খেলাপি ঋণের হার এক বছরে ৩.৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২.৫ শতাংশে এনেছে। নেপালে সামান্য বৃদ্ধি হয়েছে, মাত্র ০.৯ শতাংশ।
এডিবি উল্লেখ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশ মিলিয়ে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৬.৭৪ বিলিয়ন ডলার, যা এশিয়ার মোট খেলাপি ঋণের ১২.৪ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে উল্টো চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে; দেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে খেলাপি ঋণ ক্রমবর্ধমান।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা, বাণিজ্য দ্বন্দ্ব এবং ভূ-রাজনৈতিক সংকট আবারও বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি করতে পারে। যেসব দেশ বেশি ঋণনির্ভর বা বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল, তারা ঝুঁকিতে রয়েছে।
সরকারের পদক্ষেপ ও সুপারিশ
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নতুন গভর্নর নিয়োগের পর মন্দ ঋণ প্রকাশের মানদণ্ড কঠোর করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরও পরামর্শ দিচ্ছেন:
কঠোর ঋণ নীতি প্রয়োগ – ঋণ দেওয়ার পূর্বশর্ত, ঋণ পুনঃতফসিল এবং খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত নিয়ম কড়া করতে হবে।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো – রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।
বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি – খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা এবং বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস অর্জন করা।
আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা – ঋণ আদায়ে দ্রুত বিচার ও কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করা।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয় – ঋণ নীতি ও ব্যাংকিং তত্ত্বাবধানে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
সেলিম রায়হান বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে নেওয়া হলে বাংলাদেশ এশিয়ার খেলাপি ঋণের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে পারবে। অন্যথায়, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং অর্থনীতি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।”
জাহিদ হোসেন আরও যোগ করেছেন, “প্রকৃতপক্ষে, খারাপ ঋণের সংখ্যা প্রকাশিত হওয়া মানে সিস্টেম আরও শক্তিশালী হচ্ছে। ঋণ কম দেখানো মানে সেকেন্ডারি সমস্যার সৃষ্টি, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করতে পারে। তাই এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি।”
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি শুধুমাত্র ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় সংকেত। রাজনৈতিক প্রভাব, শিথিল নিয়ম, এবং বড় ব্যবসায়ীদের প্রভাব থাকায় সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, কঠোর নীতি, কার্যকর আইন ও স্বচ্ছ বাজার ব্যবস্থা না গড়ে তোলা হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ও নিয়মকানুন কড়া করার প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তবে দেশের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার, ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষ, আদালত এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একযোগে কাজ করতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ