
ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে কর অঞ্চল-৫, ঢাকার এক উচ্চপদস্থ কর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আয়কর নথি গায়েব করে প্রায় ১৪৬ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তার অভিযোগে উপকর কমিশনার লিংকন রায়কে সাময়িক বরখাস্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই ঘটনায় এর আগে আরও দুই জ্যেষ্ঠ কর কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যেই এ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন দিয়েছে। ফলে ঘটনাটি দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপে এক গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে লিংকন রায়ের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ঢাকার কর অঞ্চল-৫ এ কর্মরত অবস্থায় লিংকন রায় তার দায়িত্ব পালনে গুরুতর অনিয়মে জড়িত ছিলেন। তিনি পূর্বে নিষ্পত্তিকৃত মামলার আদেশ পরিবর্তন করে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি করেছেন, যা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর গুরুতর লঙ্ঘন।
সেজন্য তাঁকে বিধিমালার ১২ (১) ধারা অনুযায়ী চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তকালীন সময়ে বিধি অনুযায়ী তিনি কেবল খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।
একই ঘটনায় এর আগে কর অঞ্চল-৫, ঢাকার কমিশনার আবু সাঈদ মো. মুস্তাক ও অতিরিক্ত কমিশনার গোলাম কবীরকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আবু সাঈদ মো. মুস্তাক পরবর্তীতে এনবিআরের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু নথি গায়েব করে রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকেও সরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রশাসনিক শাস্তির পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনও এ তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে এসেছে। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) দুদক কমিশনের বৈঠকে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমোদন দেওয়া হয়। জানা গেছে, দুদকের সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম শিগগিরই মামলাটি দায়ের করবেন। মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে নাম আসবে— কর কমিশনার আবু সাঈদ মো. মুস্তাক, অতিরিক্ত কর কমিশনার গোলাম কবীর এবং উপকর কমিশনার লিংকন রায়ের।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গত ৯ জুলাই কর অঞ্চল-৫, ঢাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে তারা আবিষ্কার করে যে, ধামশুর ইকোনমিক জোন লিমিটেডের ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ করবর্ষে মোট ১৪৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকার কর দাবি করা হয়েছিল। তবে কর্মকর্তা বদলির পর নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নথিতে হস্তক্ষেপ করে কর দাবির পরিমাণ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করেন।
মূলত, প্রথমে যেখানে কর দাবির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল যথাক্রমে ৭২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ও ৭৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, সেখানে নতুন আদেশে কর দাবির পরিমাণ দাঁড়ায় যথাক্রমে শূন্য টাকা ও মাত্র ১ হাজার টাকা। ফলে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হাতছাড়া হয়। শুধু তাই নয়, এই অনিয়ম আড়াল করতে মূল কর নির্ধারণী আদেশের নথিও ইচ্ছাকৃতভাবে গায়েব করা হয়। দুদকের অভিযানে এসব নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি, যা সরাসরি উদ্দেশ্যমূলক অনিয়মের প্রমাণ বহন করে।
প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, উৎসে কর ব্যবস্থাপনা ইউনিটে কর্মরত অবস্থায় লিংকন রায় তার দায়িত্বকালে পূর্বে নিষ্পত্তিকৃত মামলার নতুন আদেশপত্র (আইটি-৩৯) এবং কর নির্ধারণ আদেশ (আইটি-৮৮) তৈরি করে নতুন কর দাবি তৈরি করেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি সরকারের মোট ১৪৬ কোটি ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার ৫৫৩ টাকা রাজস্ব ক্ষতি সাধন করেছেন।
আইন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এত বড় অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতির ঘটনায় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের প্রশাসনিক কঠোরতার প্রতিফলন। এর ফলে ভবিষ্যতে রাজস্ব প্রশাসনে কর্মরত অন্য কর্মকর্তারাও দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক হবেন।
লিংকন রায়কে সাময়িক বরখাস্ত, আরও দুই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং দুদকের মামলা অনুমোদন—সব মিলিয়ে ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম দমনে বড় পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ যদি শেষ পর্যন্ত আইনের মাধ্যমে দায়ীদের বিচারের দিকে এগোয়, তবে তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের লড়াইয়ে এক নতুন মাইলফলক হবে।
বাংলাবার্তা/এসজে