
ছবি: সংগৃহীত
এক বছর কেটে গেলেও এখনো সন্ধান মেলেনি দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৭২৪ বন্দির। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের শেষ দিকে সংঘটিত ভয়াবহ হামলায় নরসিংদী, শেরপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে মোট ২ হাজার ২৪৪ জন বন্দি পালিয়ে যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিডিআর বিদ্রোহ এবং বহুল আলোচিত হত্যামামলার আসামি। এই দীর্ঘ সময়েও বহু আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি, উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল গুলির মজুদ।
ঘটনার সময় কারাগারগুলোতে সংঘটিত হামলায় প্রাণ হারান অন্তত ১৬ জন। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে নিহত হন ছয় বন্দি, জামালপুরে সাতজন, কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুইজন এবং চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন। প্রাণহানির পাশাপাশি কারাগারের নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে আসামিদের শনাক্তকরণ ও মামলার অগ্রগতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্রের তথ্যমতে, নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে পালিয়ে যায় ৮৪৬ জন। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় ফেরত এসেছে ৬৪৪ জন, পুলিশ গ্রেফতার করেছে ৩৮ জনকে, তবে এখনো পলাতক রয়েছে ১৪২ জন। শেরপুর জেলা কারাগার থেকে পালায় ৫১৮ জন বন্দি। তাদের মধ্যে কেউ স্বেচ্ছায় ফেরত আসেনি, গ্রেফতার হয়েছে ১৩৯ জন, বাকি ৩৭৮ জন এখনো নিখোঁজ। সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে ৫৯৬ জন পালালেও ৫০৯ জন পরে ফিরে আসে, গ্রেফতার হয়েছে ৪৪ জন, পলাতক রয়েছে ৪৩ জন। কুষ্টিয়া জেলা কারাগার থেকে পালায় ১০৫ জন। পাঁচজন স্বেচ্ছায় ফেরত এসেছে, পুলিশ ধরেছে ৮১ জনকে, তবে পলাতক ১৭ জন। অন্যদিকে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে পালায় ২০২ জন। কেউ ফেরত আসেনি, তবে ৬১ জন গ্রেফতার হয়েছে। পলাতক আছে ১৪১ জন।
সবমিলিয়ে ফেরত আসা বন্দির সংখ্যা ১৬০, পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ৩৬৩ জন। কিন্তু এখনো খোঁজ নেই ৭২৪ জনের।
হামলার সময় শুধু বন্দিই নয়, লুট হয় আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদও। নরসিংদী ও শেরপুর কারাগার থেকে লুট হয় ৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, যার মধ্যে চাইনিজ রাইফেল ৩৩টি, বিডিএইড ৩৮টি এবং শটগান ২৩টি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৬৫টি অস্ত্র, কিন্তু বাকি ২৯টির কোনো হদিস মেলেনি। এছাড়া লুট হয় ৯ হাজার ১৯০ রাউন্ড গুলি। উদ্ধার হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭১২ রাউন্ড, এখনো নিখোঁজ ৭ হাজার ৪৭৮ রাউন্ড। এই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি এখনো অবাধে প্রচলিত থেকে যাওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণে বেড়েছে।
এই ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে কারা কর্তৃপক্ষ মোট ছয়টি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে নরসিংদীতে দুটি এবং শেরপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও কাশিমপুরের ঘটনায় একটি করে মামলা। কিন্তু এসব মামলার অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। এখনো পর্যন্ত এসব মামলার চার্জশিট চূড়ান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলাতক আসামিদের অনুপস্থিতিতে চার্জশিট দিলে তারা আইনের ফাঁক গলে সুবিধা পেয়ে যেতে পারে। ফলে মামলাগুলো ঝুলে আছে।
এআইজি (প্রিজনস) জান্নাত-উল-ফরহাদ জানান, “পলাতক বন্দিদের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। ওই সময় কারাগারের নথিপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে আসামিদের তথ্য জানতে গেলে আদালত বা থানার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আবার যেসব থানার নথিও পুড়ে গেছে, তাদের আসামিদের খোঁজও মেলে না।”
তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ পলাতকই সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সাধারণত এসব আসামির বিষয়ে আদালত তলব করে। কিন্তু কারাগারের হাতে কোনো তথ্য না থাকায় আদালত চাইলেও তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দেওয়া যায় না। তার ভাষায়, “মাঝে মধ্যে দু-একজন করে গ্রেফতার হচ্ছে। তারা যখন ধরা পড়ে তখন দুটি মামলার আসামি হয়—একটি পলায়নের মামলা, আরেকটি আগের মামলা।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এত বিপুলসংখ্যক পলাতক আসামি দেশের ভেতরে অজানা জায়গায় অবস্থান করছে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাজাপ্রাপ্তদের অনেকেই পালিয়ে যাওয়ায় জাতীয় নিরাপত্তার ওপর হুমকি আরও বেড়েছে।
একই সঙ্গে উদ্ধার না হওয়া অস্ত্র-গুলিও এখন বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো যদি চক্র বা সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যায়, তাহলে তা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তারা পলাতকদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাওয়ায় অনেকেই হয়তো সীমান্ত পেরিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। আদালত যদি আংশিক চার্জশিটের অনুমতি দেয়, তবে দ্রুত অগ্রগতি সম্ভব হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত মামলাগুলো ঝুলে থাকবে এবং পলাতকদের খোঁজ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ