
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের কর প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে বড় ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন তিনজন রাজস্ব কর্মকর্তা। নথি গায়েব করে সরকারের বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতির অভিযোগে কর অঞ্চল-৫ এর কর কমিশনার আবু সাঈদ মো. মুস্তাক, অতিরিক্ত কর কমিশনার গোলাম কবীর এবং উপ-কর কমিশনার লিংকন রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ রয়েছে, এ তিন কর্মকর্তা একত্রে কাজ করে সরকারের রাজস্ব থেকে প্রায় ১৪৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ফাঁকি দিতে একটি করদাতা কোম্পানিকে সুবিধা দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) দুদকের বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়। দুদকের উপ-পরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, শিগগিরই দুদকের সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম মামলাটি দায়ের করবেন। প্রাথমিকভাবে দুটি আলাদা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
এর আগে গত ১০ জুলাই দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট কর অঞ্চল-৫, সার্কেল-৯০ (কোম্পানি)-এর অফিসে অভিযান চালায়। অভিযানের সময় তারা দেখতে পান, একটি প্রতিষ্ঠানের ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ করবর্ষের আয়কর নির্ধারণ সংক্রান্ত মূল ফাইলগুলো রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে। এসব ফাইলে সরকারের রাজস্ব দাবির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা এবং ৭৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে প্রায় ১৪৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকার কর নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই নথিগুলো সচেতনভাবে গায়েব করে কোম্পানিটিকে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে দুদকের টিম সন্দেহ প্রকাশ করে।
দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযানের সময় মাসিক কর নির্ধারণ রেজিস্ট্রার ৪-এর পৃষ্ঠা নম্বর ৩-এর ৪৪ ও ৪৫ নম্বর ক্রমিকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে কর মওকুফের সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে পাওয়া যায়। অথচ এর কোনো বৈধ অনুমোদন ছিল না। তদন্তকারীরা মনে করছেন, কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশ ছাড়া এ ধরনের গড়মিল সম্ভব নয়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে নথি গায়েবের ঘটনা ঘটানো হয়েছে এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের পথ সুগম করা হয়েছে।
দুদক জানিয়েছে, তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দুটি মামলা করার প্রস্তুতি চলছে—একটি হবে নথি গায়েব করে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে, আরেকটি হবে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কর প্রশাসনের ভেতরে এমন জালিয়াতি ও দুর্নীতি দেশের রাজস্ব ব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করছে। একদিকে ব্যবসায়ীরা কর আদায়ের জটিলতায় ভুগছেন, অন্যদিকে ভেতরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়ছে না। এর ফলে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রতিটি টাকার গুরুত্ব রয়েছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারকে দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সেখানে কর্মকর্তাদের অনিয়মে শত শত কোটি টাকা ক্ষতি হওয়া সরাসরি অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজস্ব প্রশাসনের ভেতরে দুর্নীতি বন্ধ না হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে না।
সরকার ইতিমধ্যেই রাজস্ব খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি এনবিআরকে দুটি বিভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম আলাদাভাবে পরিচালিত হয়। সরকারের দাবি, এ ধরনের বড় ধরনের অনিয়ম আর যাতে না ঘটে সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিন শীর্ষ কর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এই মামলার অনুমোদন কর প্রশাসনের ভেতরে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অনিয়মের গভীর সংকটকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। দুদক বলছে, মামলার প্রক্রিয়া শেষ হলে তদন্ত শুরু হবে এবং দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে এ ধরনের ঘটনা কেবল মামলা দিয়ে সমাধান হবে না; বরং সার্বিক রাজস্ব ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা ও কঠোর তদারকি জোরদার করতে হবে—এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাবার্তা/এসজে