
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি বিস্ফোরক অভিযোগ উঠেছে যে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হুমকি দিয়েছিলেন। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সোমবার (১১ আগস্ট) চানখারপুল গণহত্যা মামলায় সূচনা বক্তব্যে এ অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং এ সংক্রান্ত একটি ফোনালাপের পূর্ণ লিখিত রূপ আদালতে পাঠ করেন।
প্রসিকিউশনের দাবি, গত বছরের ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের মধ্যে হওয়া ফোনালাপে, আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে তাদের ‘ফাঁসি দেওয়া হবে’ বলে হুমকি দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। প্রসিকিউশন ইতোমধ্যে এই ফোনালাপের অডিও ও লিখিত রূপ ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে জানান, ফোনালাপের শুরুতে মাকসুদ কামাল শেখ হাসিনাকে জানান যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হল থেকে শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে এবং চার–পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়েছে। মল চত্বরে আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ সমবেত হয়েছে, যেকোনো সময় তার বাসায়ও আক্রমণ হতে পারে—এমন শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
তখন শেখ হাসিনা তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, বাসার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কথোপকথনের মাঝে তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “তারা রাজাকার হতে চাইছে তো, তাদের সবাই রাজাকার। রাজাকারের তো ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও তাই করব। একটাও ছাড়ব না।”
কথোপকথনে শেখ হাসিনা স্পষ্ট নির্দেশ দেন যে, শুধু লাঠিসোঁটা দিয়ে আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করা যাবে না। তিনি পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ সব বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান। “সমস্ত ক্যাম্পাসে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ—সব রকম ব্যবস্থা হইছে। তোমার বাসার ভেতরে লোক রাখতে বলছি,”—এমন কথাও শোনা যায় অডিওতে।
মাকসুদ কামালও পরিস্থিতিকে ‘অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া’ হিসেবে বর্ণনা করে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা আরও জোরদারের অনুরোধ জানান। শেখ হাসিনা এতে সম্মতি দিয়ে বলেন, সহনশীলতা দেখাতে দেখাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তাই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
প্রসিকিউশনের উপস্থাপিত ফোনালাপের অংশে উঠে আসে, আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা, যাদের মধ্যে সাদ্দাম, ইনান, শয়ন উল্লেখযোগ্য, তারা মাকসুদ কামালের বাসায় অবস্থান করছিলেন। মাকসুদ তাদের দিয়ে হলে হলে গিয়ে ছাত্রলীগকে সংঘবদ্ধ রাখার কাজ করছিলেন এবং ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন।
শেখ হাসিনা এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আরও কঠোর সুরে বলেন, “রাজাকারদের কী অবস্থা হয়েছে দেখিস নাই? সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও ছাড়ব না।”
কথোপকথনের শেষদিকে শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন, যারা অস্থিরতা সৃষ্টি করছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং পরবর্তীতে গ্রেপ্তার করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি যুক্তরাজ্যের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেখানেও ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
মাকসুদ কামাল এ বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে বলেন, ঝামেলা শেষ হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব নিয়ে আন্দোলনের মূল ব্যক্তিদের শনাক্ত করে বহিষ্কার করবেন। শেখ হাসিনা এ প্রতিশ্রুতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “সব এইগুলাকে বাইর করে দিতে হবে...আমি বলে দিচ্ছি আজকে সহ্য করার পরে অ্যারেস্ট করবে, ধরে নেবে এবং যা অ্যাকশন নেওয়ার নেবে।”
আলোচনার একটি পর্যায়ে শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রপতিকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে, যা তিনি ‘বেয়াদবির সীমা’ বলে অভিহিত করেন। মাকসুদ কামালও এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কোনো দেশে রাষ্ট্রপতিকে এভাবে আলটিমেটাম দেওয়া শোভনীয় নয়।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে যুক্তি দেন যে, এই ফোনালাপ প্রমাণ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিকল্পিতভাবে আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইন লঙ্ঘনের শামিল। চানখারপুল গণহত্যা মামলার সূচনা বক্তব্যে এই ফোনালাপ উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রসিকিউশন দেখাতে চায় যে, শীর্ষ পর্যায় থেকে সরাসরি সহিংসতার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ফোনালাপ প্রকাশিত হলে দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে, কারণ এতে একজন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে আন্দোলনকারীদের প্রতি চরম হুমকি শোনা গেছে। প্রসিকিউশন বলছে, এটি কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন-পীড়নের সুস্পষ্ট প্রমাণ।
যদিও এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বা তার আইনজীবী দলের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, তবে মামলার অগ্রগতি ও এই অডিও প্রমাণ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ