
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার জন্য দায়ীদের কেউই আইনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তার ভাষায়, যারা ভেবেছিল বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়ে পার পাওয়া যাবে কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে বিচারকাজকে বানচাল করা যাবে, তাদের জন্য এটি স্পষ্ট বার্তা—“অপরাধীরা কেউ ছাড় পাবে না, বিচারের প্রক্রিয়া কোনোভাবেই বন্ধ হবে না।”
সোমবার (১১ আগস্ট) দুপুরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে তিনি রাজধানীর চানখারপুলে শিক্ষার্থী আনাসসহ ছয়জনকে হত্যা করার ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “যেসব তরুণরা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে দ্বিতীয়বার মুক্ত করেছেন, তাদের স্বজনরা এখনো বেঁচে আছেন। তাদের সাক্ষ্য ও প্রমাণের মাধ্যমে দেড় হাজারেরও বেশি প্রাণহানির ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। রাষ্ট্র এই বিচার প্রক্রিয়াকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
তিনি আরও বলেন, এই বিচার কেবল একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়, বরং ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা পূরণের একটি পদক্ষেপ। “মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাদের অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।”
এদিন মামলার প্রথম সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির হন শহীদ আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আনাসের মা, যিনি পরবর্তী পর্যায়ে সাক্ষ্য দেবেন। সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম নতুন গতি পায়।
ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে ১৪ জুলাই এ মামলার আটজন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দিয়েছে। এদের মধ্যে চারজন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন—শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন এবং মো. নাসিরুল ইসলাম।
পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার পরও ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হননি চারজন উচ্চপদস্থ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। তারা হলেন—সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম এবং রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। এদেরকে পলাতক আসামি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত ২৯ জুন রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন চেয়ে শুনানি শেষ করে। অপরদিকে, অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন শুনানির জন্য সময় চান আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। পরে ৩ জুলাই মামলাটির অভিযোগ গঠন নিয়ে দ্বিতীয় দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আসামিপক্ষে আইনজীবী সিফাত মাহমুদ শুভ এবং রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম অংশ নেন।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় শিক্ষার্থী আনাসসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়, যা দেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। রাষ্ট্রপক্ষের দাবি, এই হত্যাকাণ্ড ছিল একটি পরিকল্পিত গণহত্যার অংশ, যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সরাসরি জড়িত ছিলেন।
চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলেও তা থেমে থাকবে না। তিনি বলেন, “এ বিচার শুধুমাত্র একটি অপরাধের দায় নির্ধারণ নয়, বরং বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতীক।”
এ মামলার অগ্রগতি দেশবাসীর নজরে রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এই বিচার কেবল ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য ন্যায়বিচারই আনবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা হয়ে থাকবে—গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ করে কেউই পার পাবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ