
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার চলমান সরকারি সফরের দ্বিতীয় দিনে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েলের সঙ্গে লন্ডনে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। বৈঠকে আলোচনায় উঠে এসেছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। এসব ইস্যুতে উভয়পক্ষের মধ্যে বিস্তারিত মতবিনিময় হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বুধবার (১১ জুন) লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় শুরু হওয়া এ বৈঠকটি দক্ষিণ এশিয়ার চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে গভীর আলাপের মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়। বৈঠকে উভয় পক্ষই দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কার্যকর সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ড. ইউনূস বৈঠকে তুলে ধরেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা এমন এক অঞ্চল থেকে এসেছি, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।” তার মতে, আন্তর্জাতিক নীতিমালা প্রণয়নে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর আরও জোরালোভাবে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন।
অন্যদিকে, ব্রিটিশ নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে এখন কেবল পরিবেশগত সংকট নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবেও দেখা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ুজনিত অভিবাসন, জল সংকট এবং সীমান্ত সংঘাতের ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে, যা বৈশ্বিক নিরাপত্তার ওপরও ছায়া ফেলতে পারে। তিনি জানান, যুক্তরাজ্য এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভবিষ্যতেও কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে।
বৈঠক শেষে জানা যায়, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য খাত হিসেবে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এবং ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে দেশটির অগ্রযাত্রায় সমর্থন অব্যাহত রাখবে বলেও বৈঠকে আশ্বাস দেওয়া হয়।
চ্যাথাম হাউসে ব্যস্ত দিনের সূচনা
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দিনভর সূচি ছিল অত্যন্ত ব্যস্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ। সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে তিনি সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের এশিয়া-প্যাসিফিক প্রোগ্রামের পরিচালক বেন ব্ল্যান্ড এবং দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. চিয়েটিজ বাজপাইয়ের সঙ্গে। সাক্ষাতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক সংকট ও আন্তর্জাতিক সংযোগের ওপর বিশদ আলোচনা হয়।
এরপর সকাল ১১টায় অধ্যাপক ইউনূস চ্যাথাম হাউসের মূল হলে একটি নীতি সংলাপে মূল বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সংলাপে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এবং দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলায় তার প্রশাসনের ভূমিকা তুলে ধরেন।
সংলাপে ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশ এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার ভিত্তি সুদৃঢ় করতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যত রেখে যাব।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো রাজনৈতিক পক্ষের নয় বরং এটি একটি জাতীয় দায়িত্ব, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন।
রাজকীয় নৈশভোজে যোগদান ও রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ
দিনের শেষ ভাগে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূস সেন্ট জেমস প্যালেসে আয়োজিত এক রাজকীয় নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন। এই নৈশভোজটি ছিল ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের নেতৃত্বাধীন দ্য কিংস ফাউন্ডেশন-এর ৩৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ আয়োজন।
রাজা চার্লস স্বয়ং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং জানা গেছে, অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সামাজিক ব্যবসা, টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে আলোচনা হয়। উল্লেখ্য, রাজা চার্লস (তৎকালীন প্রিন্স চার্লস) ও ড. ইউনূস পূর্বেও একাধিক আন্তর্জাতিক উদ্যোগে একসঙ্গে কাজ করেছেন, বিশেষ করে সামাজিক ব্যবসা ও পরিবেশ রক্ষায়।
সফরের কূটনৈতিক গুরুত্ব
ড. ইউনূসের এই সফর শুধু একটি ব্যক্তিগত বা দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সফর নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে—যেখানে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের একটি নতুন অন্তর্বর্তী নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হচ্ছে। চ্যাথাম হাউস, ব্রিটিশ সরকার ও রাজ পরিবারের উচ্চ পর্যায়ের উপস্থিতি এবং আলোচনার বিষয়বস্তু—সব মিলিয়ে এটিকে একটি উচ্চতর কূটনৈতিক সফর হিসেবে বিবেচনা করছে কূটনৈতিক মহল।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই সফরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তরণ ও আগামী দিনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ড. ইউনূস যে আলোচনায় মানবিকতা, গণতন্ত্র এবং জলবায়ু সচেতনতা—এই তিনটি স্তম্ভকে সামনে রেখে এগোচ্ছেন, সেটি ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলেও অভিমত দিচ্ছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ