
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা এক গুরুতর অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক টালমাটাল সময়, বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের নেপথ্যের ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ। এই অভিযোগপত্রে যে তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তা শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়কেই তুলে ধরে না, বরং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের দমন-পীড়নের ভয়াবহতাও জনসমক্ষে নিয়ে আসে।
চার্জ দাখিল ও মামলার প্রেক্ষাপট
২০২৫ সালের ২৫ মে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দাখিল করে। মামলাটি রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গুলি চালানো এবং রাজনৈতিক দমনপীড়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঘটনা ঘিরে। এই মামলায় চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের—যাদের 'গ্যাং অব ফোর' নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ চারজন হলেন—ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান ও আসাদুজ্জামান খান কামাল।
৪ আগস্টের রাত: গোপন বৈঠক ও পদত্যাগের বিতর্ক
চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, ৪ আগস্ট রাতের একটি গোপন বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি চালানোর অনুমোদন দিতে চেয়েছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত সামরিক কর্মকর্তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে তাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। কিন্তু শেখ হাসিনা উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, গণভবনে কবর দিয়ে দাও।’ এটি স্পষ্ট করে যে, তিনি আন্দোলন দমনে সীমাহীন ক্ষমতা প্রয়োগে প্রস্তুত ছিলেন।
পরদিন, ৫ আগস্ট পর্যন্ত, একাধিক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শেখ হাসিনা সামরিক ও পুলিশ বাহিনীকে যে কোনো মূল্যে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। সেনাপ্রধান, র্যাব, পুলিশ, বিমানবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, ‘যা হওয়ার হবে, আমি ক্ষমতা ছাড়ব না।’ এই বক্তব্যটি রাজনৈতিক জেদ ও দমননীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তারেক সিদ্দিকীর উসকানি ও সামরিক উত্তেজনা
সেই বৈঠকে উপস্থিত শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী বলেন, ‘গুলিতে কয়েকজন মরলেই আন্দোলন থেমে যাবে।’ তিনি বিমানবাহিনীকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোরও প্রস্তাব দেন। এতে এক সামরিক কর্মকর্তা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই লোকটি আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডুবাবে।’ তখনই একটি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির উপস্থিতি দেখে বৈঠক সমাপ্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ রেহানা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের হস্তক্ষেপ
নথিতে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা পর্যন্ত শেখ হাসিনার পা ধরে তাকে পদত্যাগের অনুরোধ জানান, কিন্তু তিনি তাতে সম্মত হননি। পরে সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জয় তার মাকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝিয়ে রাজি করান। এরপরই শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হন।
পদত্যাগপত্র ও গোপন প্রস্থান
৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং পরে এক গোপন প্রক্রিয়ায় দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। নথিতে বলা হয়, বিদায়ের আগে শেখ হাসিনা একটি টেলিভিশন ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন, তবে সামরিক কর্তৃপক্ষ সেটির অনুমতি দেয়নি।
চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ড ও গণহত্যার অভিযোগ
চার্জশিটে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে স্কুলছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিয়ার নিহত হন।
আসামি করা হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীকে, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের সরাসরি আদেশে ৫ আগস্ট সকাল ৬টায় শাহবাগ এলাকায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালায় যাতে শহীদ মিনারের দিকে তাদের যাওয়া থামিয়ে দেওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা
আরও চাঞ্চল্যকর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৪ জুলাই রাতে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অস্ত্রসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান হামলাকারীদের সহায়তা করেন এবং হামলার সময় পুলিশ নিরাপত্তার পরিবর্তে হামলাকারীদের রক্ষা করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা
প্রসিকিউশনের মতে, এই ঘটনাগুলো একটি সুপরিকল্পিত গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘যেকোনো আন্তর্জাতিক আদালতে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হলে শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব।’ এটি একটি স্পষ্ট বার্তা যে ২০২৪ সালের আগস্টের ঘটনায় শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতাই নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধেও ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
এই চার্জশিট নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা করেছে, যেখানে সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীকে গণহত্যা ও দমন-পীড়নের অপরাধে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এবং আগামী দিনে এই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী অধ্যায় রচনা করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ