
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশকে হালাল পণ্যের আঞ্চলিক উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন, নীতিগত সহায়তা, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিম-প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও হালাল অর্থনীতিতে বাংলাদেশ যে অবস্থানে রয়েছে, তা আরও মজবুত করার ব্যাপারে সরকার এখন বেশ তৎপর।
রোববার (৩ আগস্ট) রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘Halal Economy 360: Driving Global Growth’ শীর্ষক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই)। হালাল অর্থনীতির প্রেক্ষাপট, সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে আয়োজিত এই সেমিনারে অংশ নেন দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী, নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তারা। আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার মধ্যে হালাল শিল্পে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, “বিশ্বের অধিকাংশ হালাল পণ্য অমুসলিম দেশগুলোতে উৎপাদিত হয়। এটি মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে আমাদের জন্য অবশ্যই দুঃখজনক। তবে এটি আমাদের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। যদি আমরা সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করি এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করি, তবে এই খাত থেকে বাংলাদেশ বিপুল উপার্জনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাজার দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। শুধু মুসলিম ভোক্তাই নয়, স্বাস্থ্য, পবিত্রতা ও নিরাপদ খাদ্যের মানদণ্ড বিবেচনায় অনেক অমুসলিমরাও হালাল পণ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এই বৈশ্বিক প্রবণতা আমাদের নতুন দিগন্তের ইঙ্গিত দেয়।”
বিডা চেয়ারম্যান জানান, সরকার বর্তমানে হালাল শিল্পের উন্নয়নে একাধিক ক্ষেত্রে কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে—হালাল উৎপাদনের জন্য আলাদা শিল্পাঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হালাল সার্টিফিকেশন পদ্ধতি চালু করা, পরীক্ষাগার ও গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা, দক্ষ জনবল গড়ে তোলা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, “আমরা চাই বাংলাদেশ হালাল শিল্পে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। এজন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এমন এক পরিবেশ গড়তে চাই, যেখানে উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং সরকার একই লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।”
সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা মালয়েশিয়ার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, দেশটি হালাল অর্থনীতির একটি সফল মডেল। তাদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলাদেশ দ্রুত অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, হালাল কেবল খাদ্য খাতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ফার্মাসিউটিক্যালস, কসমেটিকস, পর্যটন, আর্থিক খাতসহ নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত। বাংলাদেশে এই সম্ভাবনাময় খাতে দক্ষতা তৈরি এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার ওপর জোর দিতে হবে।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ তার বক্তব্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “উদ্ভাবন, দক্ষতা, প্রযুক্তির ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হলে অংশীদারিত্ব অপরিহার্য। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত—স্বনির্ভরতা অর্জন এবং আন্তর্জাতিক হালাল বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করা।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাব বাড়ছে। এই জনশক্তিকে যদি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে হালাল শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করা সম্ভব হবে।”
বিশ্বব্যাপী হালাল অর্থনীতির বাজার বর্তমানে প্রায় ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে এবং ২০২৮ সালের মধ্যে তা ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বাজারের মাত্র সামান্য অংশ দখল করলেও বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে।
সেমিনারের সারাংশ থেকে স্পষ্ট, সরকার হালাল পণ্যের ক্ষেত্রে শুধু রপ্তানি নয়, বরং একটি পুরো ইকোসিস্টেম গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছে, যাতে স্থানীয় উদ্যোক্তা ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী উভয়েই লাভবান হতে পারে।
বাংলাদেশ যদি সঠিক কৌশল ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে এই খাতে এগিয়ে যেতে পারে, তবে ভবিষ্যতে ‘হালাল পণ্যের হাব’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর নাম উচ্চারিত হবে নতুন সম্ভাবনার প্রতীকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ