
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নিকট গুরুত্বপূর্ণ একটি চিঠি পাঠিয়েছেন দ্বিতীয় পর্যায়ে গঠিত পাঁচটি খাতভিত্তিক সংস্কার কমিশনের প্রধানেরা। এতে তারা জোর দিয়ে অনুরোধ করেছেন, তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত প্রস্তাবনাগুলো যেন ‘জুলাই সনদে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গত রোববার, ৩ আগস্ট চিঠিটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। এতে সংশ্লিষ্ট কমিশনপ্রধানেরা উল্লেখ করেন, তারা আশাবাদী যে প্রধান উপদেষ্টা এই বিষয়ে যথাযথ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, যার মাধ্যমে দেশব্যাপী সংস্কার প্রচেষ্টা আরও সুসংগঠিত ও কার্যকর হবে।
চিঠিতে তারা বলেন, প্রথম পর্যায়ে গঠিত ছয়টি বিষয়ভিত্তিক কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে জাতীয় ঐকমত্যের সংলাপ হয়েছে, সেটি নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী এবং দেশের গণতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। তবে পাশাপাশি তারা স্মরণ করিয়ে দেন যে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং একটি নতুন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের নির্মাণে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংস্কার কমিশনগুলোর কাজও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
চিঠিতে কমিশনপ্রধানেরা সরকারকে দুটি তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন:
প্রথমত, এখনই যেসব সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো নির্বাচন করে দ্রুত প্রয়োগ শুরু করা।
দ্বিতীয়ত, বাকি সংস্কারগুলো ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারও যেন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করে, সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা। এজন্য এসব সুপারিশকে জুলাই সনদের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি বলে মত দেন তারা।
চিঠিতে সতর্ক করে বলা হয়, যদি জুলাই সনদে গণমাধ্যম, নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য এবং স্থানীয় সরকার খাতভিত্তিক সংস্কারগুলোর সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দলগুলো সেগুলো অবহেলা বা বাতিল করার সুযোগ পেয়ে যাবে। এতে জনসাধারণের মধ্যে যে প্রত্যাশা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং জাতীয় জীবনে হতাশা ও বিভ্রান্তির জন্ম দেবে।
চিঠিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, গত জুলাইয়ের গণআন্দোলনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী, শ্রমিক এবং সাংবাদিক প্রাণ দিয়েছেন। এই আত্মত্যাগ শুধু তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক উত্তালতা নয়, বরং একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বপ্নকে জাগ্রত করেছে। এই আত্মত্যাগ থেকে যে ন্যায্য প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তা পূরণে সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
চিঠিতে কমিশনপ্রধানেরা প্রধান উপদেষ্টার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, যিনি তাদের ওপর স্ব স্ব খাতে সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব তৈরির দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তারা বলেন, এটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা সংস্কারের ধারাকে বহমান করেছে এবং নীতিনির্ধারকদের ওপর ইতিবাচক চাপ তৈরি করেছে।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী কমিশনপ্রধানেরা হলেন—
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, শ্রম সংস্কার কমিশন প্রধান
শিরীন পারভিন হক, নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রধান
তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান
জাতীয় অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন প্রধান
কামাল আহমেদ, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় পর্যায়ের এই পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছিল দেশের অন্তর্গত বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থা, বৈষম্য এবং কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে। এই কমিশনগুলোর মাধ্যমে প্রস্তাবিত হয়েছে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, শ্রম অধিকার, স্বাস্থ্য সেবার আধুনিকায়ন, নারীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় কার্যকর নীতি কাঠামো।
এই চিঠি প্রধান উপদেষ্টার সামনে এক নতুন দায়বদ্ধতা ও পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। জুলাই সনদে এই সংস্কারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারগুলোর নিকট একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠানো না গেলে, দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে স্থায়িত্ব আনা কঠিন হতে পারে বলেই মত বিশ্লেষকদের।
এখন দেখার বিষয়, এই গুরুত্বপূর্ণ অনুরোধের পর সরকার কতটা দ্রুত এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, সংস্কার এখন শুধু নীতিমালার প্রশ্ন নয়—এটি হয়ে উঠেছে একটি জনআকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ