
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম বর্তমানে এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের নামে সেখানে ব্যাপক ধরণের দমন-পীড়ন এবং উচ্ছেদ অভিযানে বাঙালি ভাষাভাষী মুসলিম সম্প্রদায় চরমভাবে টার্গেট হচ্ছে। মাত্র এক মাসের মধ্যে রাজ্যের পাঁচটি অভিযানে অন্তত ৩,৪০০ মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। ঘরবাড়ি উচ্ছেদ এবং নাগরিকত্বের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলাসহ জোরপূর্বক বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদন অনুসারে, আসামের নীল ত্রিপল এলাকা এবং বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন স্থানে শত শত মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুরা অত্যন্ত সংকটাপন্ন অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছে। অনেকের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তারা কিছুদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে রোদ-বাতাসে বসবাস করছেন। এই উচ্ছেদ অভিযানের প্রেক্ষাপটে তাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা ‘সরকারি জমি অবৈধ দখলকারী’ বলে এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে, অথচ অধিকাংশ পরিবারই আসামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
৫৩ বছর বয়সী আরান আলি, যিনি নিজে এই অভিযানের শিকার, বলেন, “সরকার আমাদের বারবার হয়রানি করছে। আমাদের দখলদার এবং বিদেশি বলে চিহ্নিত করছে।” তিনি ও তাঁর পরিবার বর্তমানে গোলপাড়া এলাকার খোলা মাঠে রোদে পুড়ে দিন কাটাচ্ছেন।
আসাম রাজ্যের বিজেপি সরকার গত কয়েক দশকে এ রকম উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে, তবে সাম্প্রতিক সময়ের অভিযান সবচেয়ে ব্যাপক এবং ভয়াবহ। রাজ্যের বাঙালি মুসলিমদের ‘বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ বলে লক্ষ্য করে চলছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এই দমন-পীড়ন তীব্রতর হয়েছে।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা, যিনি বিজেপির একজন পরিচিত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী নেতা, বারবার বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের সংখ্যালঘু জাতিকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং এদের উচ্ছেদ না করলে রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই মুসলিম অভিবাসী ছিলেন।
২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনে যা প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অমুসলিম অভিবাসীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ দেয়, কিন্তু মুসলিমদের জন্য তা প্রযোজ্য হয়নি। এরপর থেকে হিমন্ত শর্মার নেতৃত্বে আসামে অন্তত ৫০,০০০ মুসলিমকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী। শুধু গত এক মাসে পাঁচটি অভিযানে ৩,৪০০ মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক প্রভীন দোন্থি বলেন, “বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমরা, আইনি অবস্থান যাই হোক না কেন, ভারতে দক্ষিণপন্থী দলগুলোর জন্য সহজ টার্গেট হয়ে উঠেছে।”
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই পরিস্থিতির তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, তারা ক্ষমতায় এলে এই উচ্ছেদ অভিযানের সব ক্ষতি মেরামত করবে এবং যারা অবৈধ উচ্ছেদ করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। কংগ্রেসের নেতা আকিল গগৈ বলেন, “বিজেপি রাজনৈতিক সুবিধার জন্য এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে।”
এই পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতের বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে নিরাপত্তার অজুহাতে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে আটক করা হয়েছে। কাশ্মীরের হিন্দু পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করায় ভারতের শক্তি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে মুসলিমদের প্রতি কঠোরতা আরও বেড়েছে।
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের টানাপোড়েনের মাঝে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কিছু হামলার ঘটনাও রাজনৈতিক অশান্তির একটি ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা নিয়মিত সামাজিক মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারীদের ছবি পোস্ট করে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
অন্যদিকে, ভারতের অন্য দিক থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে “পুশব্যাক” বা জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর ঘটনাও বাড়ছে। আসাম এবং অন্যান্য অঞ্চলের শত শত মুসলিমকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। কেউ কেউ আদালতের শুনানির মধ্যেও ‘বিদেশি’ হিসেবে ঘোষিত হয়ে ফিরে এসেছে। আসামের রাজ্য সরকার বলছে, এখন পর্যন্ত তারা ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে ‘বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু অধিকাংশই দীর্ঘদিনের বাসিন্দা এবং জমি-ঘরবাড়ির মালিক।
ভারত সরকার ২০১৬ সালে জানিয়েছিল দেশজুড়ে প্রায় ২ কোটি বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী রয়েছে, তবে এই পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া পরিচালক ইলায়ন পিয়ারসন বলেন, “অবৈধ অভিবাসী শনাক্তের নামে ভারত সরকার হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন করছে, যা মূলত মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক নীতির প্রকাশ।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ২,৩৬৯ জনের তালিকা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়েছে, যাচাই দ্রুত শেষ করার অনুরোধ করেছে, তবে ঢাকাও এখনো এ বিষয়ে কোনো প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসামের রাজনীতিতে আগে জাতিগত জাতীয়তাবাদ বিরাজ করলেও এখন সেটি হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে গেছে, যার ফলে প্রধান টার্গেট বাঙালি মুসলিমরা। এই পরিস্থিতিতে আসাম এবং ভারতজুড়ে বাঙালি ভাষাভাষী মুসলিমরা নিপীড়নের শিকার হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি, যেখানে ভোটের রাজনীতিতে তাদের অস্তিত্ব বিভাজনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা এই উচ্ছেদ অভিযানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন এবং বলছেন, এটি শুধু আসাম বা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংকটের রূপ নিয়েছে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপর ধর্ম ও বর্ণের ভিত্তিতে অবিচার চলছে। এই পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন।
তবে রাজনৈতিক স্বার্থে এ ধরনের কৌশল চলতে থাকায় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ অসহায়। তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস, পরিবার ভাঙা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আসামের সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সুনির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোর জন্য এক মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই সংকট দ্রুত সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দুই দেশের সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যাতে ধর্মীয় ও ভাষাগত বৈচিত্র্যের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
সংক্ষিপ্ত কথায়, আসামে এই মুহূর্তে ৩৪০০ মুসলিম পরিবার তাদের বসতভূমি হারিয়ে মানবিক সঙ্কটে পড়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তে জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর ঘটনাও বেড়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক কারণে পরিচালিত এই উচ্ছেদ ও নিপীড়ন কার্যক্রম দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ