
ছবি: সংগৃহীত
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি অঞ্চলে গত এক সপ্তাহ ধরে অস্থিরতা চরমে উঠেছে। দোকানপাট বন্ধ, অবরোধ, ভাঙচুর, সহিংসতা থেকে শুরু করে নারী-শিশুদের সড়কে নামানো পর্যন্ত নানা ঘটনায় এলাকাজুড়ে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। এই পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী ও আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বলছে, এর পেছনে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তাদের অভিযোগ, পাহাড়ি সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে সচেষ্ট এবং এজন্য নারী-শিশুদেরও ‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে’ অংশ নিতে বাধ্য করছে।
আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেলচালক মামুনকে হত্যার পর থেকেই ইউপিডিএফ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সে সময় উত্তেজনা ছড়াতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও অনেকেই আহত হয়। ওই ঘটনার এক বছর পূর্তিতে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইউপিডিএফ বিভিন্ন কর্মসূচির নামে নতুন করে উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে।
চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সন্দেহভাজন হিসেবে শয়ন শীল নামের এক যুবককে সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে এবং পরে পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেয়। মামলাটি আইনের গতিপথে চললেও ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) নেতা উখ্যানু মারমা ‘জুম্ম ছাত্র জনতার’ ব্যানারে আন্দোলনের ডাক দেন। মানববন্ধন, বিক্ষোভ এবং পরে হরতালের মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
২৪ সেপ্টেম্বরের বিক্ষোভের পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ অর্ধদিবস হরতাল ডাকে। এই সময় দেশি-বিদেশি কিছু ব্লগার ও পাহাড়ি-বাঙালি নেতাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের অভিযোগ ওঠে। ২৬ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জুড়ে অবরোধ চলাকালে টহলরত সেনাদের ওপর ইট-পাটকেল ছোড়া হয়, এতে তিন সেনাসদস্য আহত হন। সেনাবাহিনী কোনো পাল্টা বলপ্রয়োগ না করে সংযমের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
২৭ সেপ্টেম্বর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। ইউপিডিএফ কর্মীরা দাঙ্গার চেষ্টা চালায়, সাধারণ মানুষের ওপর গুলি ছোড়ে, অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করে, রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়।
২৮ সেপ্টেম্বর সকালে ইউপিডিএফ কর্মীরা গুইমারার রামসু বাজার এলাকায় ১৪৪ ধারা অমান্য করে অবরোধ গড়ে তোলে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় লিপ্ত হয় এবং সেনা টহল দলের ওপর দেশীয় অস্ত্র, গুলতি ও ইট-পাটকেল নিয়ে হামলা চালায়। এতে তিন সেনা কর্মকর্তা ও অন্তত ১০ সেনাসদস্য আহত হন। একই সময়ে রামগড়ে বিজিবির গাড়িও ভাঙচুর হয় এবং সদস্যরা আহত হন।
এর কিছুক্ষণ পর পাহাড় থেকে ইউপিডিএফ সশস্ত্র দল অন্তত ১০০ থেকে ১৫০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে সেনা সদস্য ছাড়াও পাহাড়ি ও বাঙালি সাধারণ মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। সেনাবাহিনী পাল্টা অভিযান চালালে সশস্ত্ররা পালিয়ে যায়। তবে ততক্ষণে বহিরাগত দুষ্কৃতকারীরা বাজারে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও হামলা চালায়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অতিরিক্ত সেনাদল মোতায়েনের পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
আইএসপিআরের অভিযোগ, ইউপিডিএফ কৌশলগতভাবে নারী ও কোমলমতি শিশুদের সামনে ঠেলে দিয়ে নাশকতার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ পার্বত্য অঞ্চলে ঢোকানো হচ্ছে। ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে বিজিবির কাপ্তাই ব্যাটালিয়নের চেকপোস্টে ইউপিডিএফ পরিবহনকৃত বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্রও জব্দ করা হয়।
আইএসপিআর মনে করছে, ১৯ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার মাধ্যমে স্পষ্ট যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্র চলছে। এসব ঘটনার প্রমাণাদি ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত আছে।
বিবৃতিতে সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের সব জাতিগোষ্ঠীকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। আইএসপিআর বলেছে, “সব ধরনের অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য ও উসকানিমূলক কার্যক্রম সত্ত্বেও সেনাবাহিনী দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
সেনাবাহিনী আরও জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোনো পদক্ষেপ নিতে তারা প্রস্তুত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ