
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আসন্ন নির্বাচনে বিএনপিপন্থি শিবিরে তুমুল অস্থিরতা বিরাজ করছে। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালের নেতৃত্বাধীন প্যানেল প্রথমদিকে যেমনটা সাজানো-গোছানো আকারে প্রকাশ পায়নি, শেষ মুহূর্তে তা আরও জটিলতায় জড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে বিএনপি শিবিরের অন্যতম হাই-প্রোফাইল প্রার্থী ইশরাক হোসেন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পুরো সমীকরণ পাল্টে দেন। এতে প্যানেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন খালি হয়ে যায় এবং সেটি পূরণ করতে গিয়ে তৈরি হয় নতুন বিতর্ক ও অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন।
ইশরাকের নাম বাদ পড়ার পর বিএনপি ঘরানার প্রভাবশালী চার নেতার সন্তান—ইসরাফিল খসরু, সাইদ ইব্রাহীম আহমেদ, ইয়াসির আব্বাস এবং ওমর শরীফ মোহাম্মদ ইমরান—কে হঠাৎ করেই প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সিদ্ধান্ত ছিল অনেকটা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তাৎক্ষণিক উদ্যোগ। যদিও এতে তাৎক্ষণিক সংকট কিছুটা প্রশমিত হয়, তবে প্যানেলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে, এই প্যানেলেরই পরিচিত দুই মুখ—বর্তমান বোর্ড পরিচালক ইফতিখার রহমান মিঠু ও মঞ্জুরুল আলম—শেষ পর্যন্ত জায়গা পাননি তামিমের তালিকায়। এতে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে আলাদা নির্বাচন করার ঘোষণা দেন এবং নিজেদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরও কয়েকজন পরিচিত সংগঠক, যেমন ফায়জুর রহমান মিতু, আদনান দিপন ও বোরহান হোসেন পাপ্পু। ফলে একপক্ষ হয়ে দাঁড়াল তামিম-ফাহিম সিনহা-রফিকুল ইসলাম বাবু-শাহনিয়ান তানিমদের নেতৃত্বাধীন মূল প্যানেল, আরেকপক্ষ তামিম ঘরানারই বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
এই বিভাজন বিএনপি শিবিরে অঘোষিত ফাটলের ইঙ্গিত দিয়েছে। একই আদর্শে বিশ্বাসী এবং শুরু থেকেই একসঙ্গে কাজ করা লোকজন হঠাৎ করে আলাদা নির্বাচন করলে সামগ্রিকভাবে প্যানেলের শক্তি কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে করে বিএনপিপন্থি ভোট ব্যাংক ছিন্নভিন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার ক্লাবভিত্তিক কাউন্সিলরদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, কোন তালিকাকে সমর্থন করবেন তা নিয়ে।
এ পরিস্থিতি সামলাতে সোমবার দিনভর কয়েক দফা বৈঠকে বসেন তামিম ইকবালের ঘনিষ্ঠরা। আলোচনায় উঠে আসে—বিদ্রোহী প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্তির দাবি। বিশেষ করে ইফতিখার রহমান মিঠু, মঞ্জুরুল আলম, ফায়জুর রহমান মিতু ও বোরহান হোসেন পাপ্পুকে প্যানেলে ফেরানোর জোরালো প্রস্তাব ওঠে। এক পক্ষের দাবি ছিল, প্রয়োজনে টি স্পোর্টস ঘরানার প্রার্থী শাহনিয়ান তানিম ও ইশতিয়াক সাদেকের মধ্যে একজনকে বাদ দিয়ে হলেও ওই চারজনকে যুক্ত করতে হবে। কিন্তু খোদ তামিম ইকবাল এতে অনড় থাকেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, টি স্পোর্টসের দুজন প্রার্থীই তার প্যানেলে থাকতে হবে, কাউকে বাদ দেওয়া হবে না।
এদিকে আরও একটি ইস্যুতে তামিম শিবিরের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ক্যাটাগরি ২—ঢাকার ক্লাব ক্যাটাগরি—থেকে ১২ পরিচালকের মধ্যে বিএনপি ঘরানার জন্য ৯ জন এবং প্রতিপক্ষ বুলবুল ঘরানার জন্য ৩ জনের ‘৯:৩ ফর্মুলা’ দিয়েছেন। তামিমপন্থিদের একটি অংশ বলছে, এই ফর্মুলা বাড়িয়ে ১০:২ বা ১১:১ করতে হবে। তারা ক্রীড়া উপদেষ্টাকে জানাতে চায় যে, তারা বুলবুলকে সভাপতি ও তামিমকে সহসভাপতি মেনে নিলেও পরিচালকদের সংখ্যা নিয়ে ছাড় দিতে রাজি নন।
তাদের যুক্তি—ক্যাটাগরি ২ থেকে বিএনপি ঘরানার প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো না হলে পুরো প্যানেলের জয়ের সম্ভাবনা কমে যাবে। তাই উপদেষ্টার সঙ্গে সমঝোতা করে হলেও সংখ্যাগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নির্ভর করছে উপদেষ্টার সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি যদি তার অবস্থানে অটল থাকেন, তবে আগের তালিকায় থাকা ৯ জনই প্যানেলে থাকবেন, সঙ্গে যুক্ত হবেন তার পছন্দের ফারুক আহমেদ, মেজর (অব.) ইমরোজ ও আমজাদ হোসেন। সেক্ষেত্রে নতুন করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ থাকবে না।
বিসিবি নির্বাচনের আগে বিএনপিপন্থি প্যানেলের এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা পুরো নির্বাচনী সমীকরণকেই ঘোলাটে করে তুলেছে। বিদ্রোহী প্রার্থীরা যদি শেষ পর্যন্ত প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করেন, তবে ভোট বিভাজন হবে নিশ্চিত। এতে করে প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরগুলো ফায়দা লুটতে পারে। এখন দেখার বিষয়—তামিম ইকবাল নেতৃত্বাধীন শীর্ষ কর্তারা কতটা সমঝোতায় আসতে পারেন এবং ক্রীড়া উপদেষ্টার ফয়সালায় কোন পক্ষ লাভবান হয়।
একইসঙ্গে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, বিএনপিপন্থি শিবিরের এই অস্থিরতা প্রমাণ করছে, তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত এখনও ঐক্য গড়ে ওঠেনি। ফলে নির্বাচনের মাঠে নামার আগে তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে নিজেদের ভেতরের এই ফাটল মেরামত করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ