
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে সদ্য প্রস্তুত হওয়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’–এর পূর্ণাঙ্গ খসড়া। শনিবার এটি ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যার নেতৃত্বে আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এই সনদে মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব যুক্ত হয়েছে এবং প্রতিটি প্রস্তাবে কোন দল সমর্থন দিয়েছে আর কোন দল আপত্তি তুলেছে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সবচেয়ে আলোচিত সুপারিশ এসেছে সনদের ২১তম প্রস্তাবে, যেখানে জাতীয় সংসদের পাশাপাশি ১০০ আসনের একটি উচ্চকক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। সিপিবি ছাড়া প্রায় সব দল এই প্রস্তাবের পক্ষে। আরও বলা হয়েছে, আসন বণ্টন হবে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) বা ভোটের অনুপাত অনুযায়ী। তবে বিএনপি ও এনডিএম এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, নির্বাচনের আগেই উচ্চকক্ষের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সীমাবদ্ধ করে দেবে। এই কারণে দুটি দলই খসড়ার এ অংশে স্পষ্টভাবে ভিন্নমত জানিয়েছে।
সনদের ১৫তম সুপারিশে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী একইসঙ্গে দলীয় প্রধান হতে পারবেন না। এ বিধান সংবিধানে সংযোজন করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এই সুপারিশের বিরোধিতা করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। তাদের মতে, এটি রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য খসড়ায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল রাখা হবে, তবে এর পাশাপাশি প্রতিটি দলের প্রার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে ৫ শতাংশ নারীকে সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে হবে। এই প্রস্তাবে ২৬টি দল সম্মত হয়েছে। জামায়াত আপত্তি তোলার ইঙ্গিত দিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেয়নি।
সব দল একমত হয়েছে যে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিটি গঠন করা দরকার। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন, ন্যায়পাল, মহাহিসাব নিরীক্ষক, কর্মকমিশন ইত্যাদি নিয়োগে বিএনপিসহ চারটি দল আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মতে, এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
সনদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নাগরিকদের পরিচয় হবে ‘বাংলাদেশি’। এ প্রস্তাবে ৩১টি দল সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে সংবিধানের ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ অনুচ্ছেদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোটের বিধান যোগ করতে ৩০টি দল সম্মতি দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উভয় কক্ষের সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটে নির্বাচন করার প্রস্তাব সমর্থন করেছে ২৮টি দল। কেবল ইসলামী আন্দোলন এতে আপত্তি জানিয়েছে।
সনদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল, আইন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হবে। এর মধ্যে শেষ দুটি বিষয়ে বিএনপিসহ ছয়টি দল আপত্তি জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও তৃতীয় বৃহত্তম দলের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত নাম থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। তবে সমঝোতা না হলে বিচারপতিরা ভোট দিয়ে নির্ধারণ করবেন। বিএনপিসহ সাতটি দল এই বিধান মানতে রাজি হয়নি।
সব দল একমত হয়েছে যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব সরকারের পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকবে। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের স্থানীয় সরকারের অধীনে আনার প্রস্তাবে ২৬টি দল সম্মত হয়েছে।
এইভাবে জাতীয় সনদ–২০২৫ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। তবে বিএনপি ও এনডিএমের আপত্তি পুরো প্রক্রিয়ার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ