
ছবি: সংগৃহীত
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই—এমন স্পষ্ট অবস্থান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক দীর্ঘ বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন। বৈঠকটিকে চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিনিধিরা বিকেল থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পৌঁছান। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়টি কেন্দ্রীয় আলোচনায় উঠে আসে। কমিশন সদস্যরা জানান, জুলাই সনদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে তারা ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে গঠিত ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটির প্রস্তাবনাগুলোও প্রধান উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরা হয়।
কমিশনের সদস্যরা বৈঠকে স্পষ্ট করেন যে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাঁরা জানান, কমিশন খুব শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে তুলে দেবে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরবর্তী বৈঠক আগামী রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হবে বলেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকের মূল আলোচনায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানতম তিনটি ম্যান্ডেট হলো—সংস্কার, নির্বাচন এবং বিচার। এর মধ্যে কোনো একটি অবহেলা করলে সামগ্রিক লক্ষ্য ব্যাহত হবে। তাই নির্বাচন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সংস্কারকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন কেবল একটি সাধারণ নির্বাচন নয়, এটি হবে একটি ফাউন্ডেশনাল ইলেকশন। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে বাংলাদেশের আগামীর দিকনির্দেশনা ও রাজনৈতিক ভিত্তি। এজন্য মৌলিক সংস্কারগুলোকে নির্বাচনের আগেই চূড়ান্ত করতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো বিকল্প নেই।”
বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, অর্থনীতিবিদ ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, আইন বিশ্লেষক আসিফ নজরুল, পরিবেশ আন্দোলনের নেতা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সবাই এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় গতি আনার ওপর গুরুত্ব দেন।
আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা বলেন, জুলাই সনদ কেবল একটি নথি নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক চুক্তি ও ভবিষ্যৎ সংস্কারের রূপরেখা। এই সনদ বাস্তবায়ন হলে কেবল নির্বাচনই নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা পাবে। এজন্য তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন চান।
প্রধান উপদেষ্টা জবাবে আশ্বস্ত করে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রক্রিয়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে অনিশ্চয়তাকে অনেকটাই দূর করেছে। তবে এখনও অনেক প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—সংস্কারগুলোর কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারবে এবং নির্বাচনী পরিবেশ কতটা শান্তিপূর্ণ থাকবে।
সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবারের এই বৈঠক বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ় ঘোষণা স্পষ্ট করেছে যে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে সংস্কারের গতি, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সমঝোতার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ