
ছবি: সংগৃহীত
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আবারও জোরালো উদ্যোগ নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কক্সবাজারে আগামী ২৪ থেকে ২৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যেখানে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে উপস্থিত থাকবেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের (৩০ সেপ্টেম্বর) আগে এই সম্মেলনকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, রোহিঙ্গাদের যে কোনো মূল্যে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। যদিও রাখাইন রাজ্যের চলমান অস্থিরতা ও বাংলাদেশে নতুন করে আরও রোহিঙ্গার আশ্রয় নেওয়ার কারণে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে সন্দেহ রয়ে গেছে।
উখিয়ার ক্যাম্পে গত রমজানে রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস ঘোষণা দিয়েছিলেন, "এই ঈদ না হোক, আগামী ঈদে তোমরা নিজেদের ঘরে ঈদ করবে।" তিনি আঞ্চলিক ভাষায় আরও বলেন, “আল্লাহর কাছে দোয়া করি, সাম্মার বার যেন তোমরা নিজের বাড়িতে ঈদ করতে পারো।” সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তিনি অটল আছেন।
তিনি আরও বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারতের সুযোগ নেই। তাই তাদের দেশে ফেরাতে হলে প্রয়োজনে সারা বিশ্বের সঙ্গেই লড়তে হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন। তিনি বলেন, "সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে, আন্তর্জাতিক মহলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই এই আয়োজন।"
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশ এককভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে পারবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে।"
প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, অন্তত ৪০টি দেশের প্রতিনিধি, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এতে অংশ নেবে। এরপর দোহায় আরও একটি বড় সম্মেলনের আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, "সরকার যতই চেষ্টা করুক, বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঁচজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। রাখাইনে আরাকান আর্মি ও জান্তা সেনার লড়াই চলছে। এই অবস্থায় নিরাপদ প্রত্যাবাসন একেবারেই অবাস্তব।"
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। গাজা যুদ্ধের মতো বড় সংকটে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের ওপর ভরসা করাও কঠিন।
বাংলাদেশে বর্তমানে অন্তত সাড়ে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। শুধু ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত নতুন করে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এতে দেশের ওপর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চাপ বাড়ছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গা ইস্যুটি আবারও আলোচনায় তুলতে চায়। জাতিসংঘের অধিবেশনে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য কক্সবাজারের সম্মেলনকে "ফলোআপ আয়োজন" হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় বলছে, নির্বাচনের মতো গুরুত্ব দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতেও তারা কাজ করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ, মিয়ানমার সরকারের অনাগ্রহ এবং আন্তর্জাতিক মহলের উদাসীনতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কঠিন করে তুলেছে। তবু ড. ইউনূস রাজনৈতিক ও মানবিক দিক থেকে এই ইস্যুকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানো জরুরি।
সবমিলিয়ে বলা যায়, কক্সবাজারে শুরু হতে যাওয়া এই তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক ও মানবিক পদক্ষেপ। এখন দৃষ্টি থাকবে, সম্মেলন শেষে বাস্তবে কতটা অগ্রগতি আসে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ