
ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের প্রস্তুতি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে ধরে নিয়েই প্রস্তুতি চলছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনকে একটি ‘মাইলফলক’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বিতীয় সমন্বয় সভা, যেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে জানানো হয়, নির্বাচনে প্রায় ৬০ হাজার সেনা সদস্য মাঠে থাকবেন। তাঁরা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া পাঁচ লাখ ৭০ হাজার আনসার ও এক লাখ ৪১ হাজার পুলিশ সদস্য নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন। একই সঙ্গে ১৭ হাজার নতুন সদস্য নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়াও চলছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, যেকোনো পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম জানান, পুলিশকে স্ট্রাইকিং ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং সহিংসতা মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত থাকবে।
নির্বাচন ঘিরে গুজব, মিথ্যা তথ্য এবং বিদেশি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সরকার ‘ন্যাশনাল ইনফরমেশন সেন্টার’ গঠনের চিন্তা করছে। এই কেন্দ্র থেকে দেশের প্রতিটি অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করে গুজব শনাক্ত এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ করা হবে। এতে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও সমন্বয় নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে। তাদের উদ্দেশে বলা হয়, নির্বাচনের সময় যেন কোনো গোয়েন্দা দুর্বলতা না থাকে এবং সংকট সৃষ্টি না হয়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে নভেম্বর পর্যন্ত দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনী পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং নির্বাচনী এলাকায় বডিক্যাম ও সিসিটিভি স্থাপনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মনিটরিং সেল গঠনের কথা বলা হয়েছে। এসব সেল থেকে নির্বাচনকেন্দ্রিক যেকোনো অনিয়মের তাৎক্ষণিক প্রতিবেদন পাঠানো হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভোটের আগে বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনিক রদবদল করা হবে। বিশেষ করে ডিসি, এসপি, ওসি ও টিএনওদের ক্ষেত্রে এই রদবদলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দেশজুড়ে ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ নজরদারি, অতিরিক্ত নিরাপত্তা, সিসিটিভি, এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ ইউনিট মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে।
অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, “এই নির্বাচন শুধু ভোটের প্রশ্ন নয়, এটি দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নির্ধারক। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করা জরুরি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা হাফিজ বলেন, “নির্বাচনের আগে যে ধরনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা স্বাগতযোগ্য। তবে মাঠপর্যায়ে এর যথাযথ বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ।”
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “নির্বাচনে সেনাবাহিনী ও পুলিশ একত্রে কাজ করবে, এটি ইতিবাচক। তবে নজরদারি ও সুশৃঙ্খল সমন্বয় ছাড়া তা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।”
প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ সূত্র ও গতকালের বৈঠকের বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা থেকে আভাস মিলেছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও এবিষয়ে সংলাপ চলছে এবং ৫ থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হতে পারে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, “নির্বাচন নিয়ে যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা বা সন্ত্রাসের আশঙ্কা রয়েছে বলেই গোটা দেশজুড়ে সতর্কতা ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।”
বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানান, অতীতে নির্বাচন ঘিরে যে বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে, এবার তা প্রতিরোধে সরকার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এবারের নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচনী কাঠামোকে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একযোগে কাজ চলছে।
প্রধান উপদেষ্টার বার্তা ছিল স্পষ্ট: “নির্বাচনের অজুহাতে যেন কোনো ষড়যন্ত্র সফল না হয়, সেটিই আমাদের লক্ষ্য। দেশ ও জনগণের শান্তি-স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে যারা গণতান্ত্রিক ধারা রুদ্ধ করতে চায়, তাদের প্রতিহত করতেই এই কঠোর প্রস্তুতি।”
এই নির্বাচনের সফলতা এখন নির্ভর করছে সরকারের প্রস্তুতির বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার ওপর। জনগণের প্রত্যাশা একটাই— একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ