
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত একটি বিশাল নৌবহর যাত্রা শুরু করেছে। “গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা” নামে পরিচিত এই বহরে রয়েছেন বিভিন্ন দেশের শত শত মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শান্তিকর্মীরা। কিন্তু যাত্রার শুরু থেকেই বহরটি ইসরায়েলি সামরিক বাধা ও হুমকির মুখে পড়েছে। বুধবার (১ অক্টোবর) স্থানীয় সময় ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফায় ইসরায়েলের যুদ্ধজাহাজ বহরের জাহাজগুলোকে ঘিরে ধরে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
ফ্লোটিল্লার অন্যতম জাহাজ “আলমা” ছিল বহরের সামনের সারিতে। গাজার উপকূল থেকে প্রায় ১৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে পৌঁছালে একটি ইসরায়েলি যুদ্ধজাহাজ হঠাৎ করেই আলমাকে ঘিরে ধরে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, যুদ্ধজাহাজটি বিপজ্জনক কৌশল প্রয়োগ করে এবং ভয়ঙ্কর গতিতে আলমার চারপাশে ঘুরতে থাকে, যা একটি বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে।
আলমার যাত্রী থিয়াগো আভিলা বলেন, “ইসরায়েলি যুদ্ধজাহাজ এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল যে আমাদের জাহাজের ক্যামেরা, সরাসরি সম্প্রচার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়ে। আমাদেরকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।”
একই সময় বহরের আরেকটি জাহাজ “সাইরিয়াস”-কে প্রায় ১৫ মিনিট ঘিরে রাখে ইসরায়েলের নৌবাহিনী। জাহাজটির যাত্রী লিসি প্রোয়েঙ্কা জানান, “আমরা সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। কোথাও সাহায্যের জন্য বার্তা পাঠানো যাচ্ছিল না।”
বহরের সবচেয়ে বড় জাহাজ “কনসায়েন্স”-এ অবস্থান করছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম। তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “এইমাত্র সংবাদ এলো—আলমার ওপর আক্রমণ হয়েছে। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে সিগনালও বন্ধ হয়ে গেল। আমরা সবাই এখন একসাথে আছি, উদ্বেগে আছি। আলমা যেহেতু সামনের দিকে ছিল, আমাদের পেছনের জাহাজগুলোর ওপরও একই আক্রমণ হতে পারে।”
শহিদুল আলমের এই ভিডিও বার্তা দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আসলে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলাকে ঘিরে ইসরায়েলের হুমকি নতুন নয়। এর আগে দেশটির প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছিল, কোনোভাবেই তারা এই বহরকে গাজার উপকূলে পৌঁছাতে দেবে না। চলতি বছরের জুন ও জুলাই মাসেও গাজার উদ্দেশে যাত্রা করা দুটি নৌবহর ইসরায়েলি বাহিনী আটকে দিয়েছিল। এবারও তারা একই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এমনকি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে যে, ইসরায়েল ফ্লোটিল্লার কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছে।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা শুধু একটি সাধারণ ত্রাণ মিশন নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক মানবিক সংহতির প্রতীক। বহরে রয়েছে ৪০টিরও বেশি বেসামরিক নৌকা, আর তাতে যাত্রীসংখ্যা প্রায় ৫০০ জন। যাত্রীদের মধ্যে রয়েছেন ইতালির রাজনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং সুপরিচিত পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সুইডেনের গ্রেটা থানবার্গ।
ফ্লোটিলার মুখপাত্র জানায়, এরা সবাই স্বেচ্ছাসেবীভাবে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে অংশ নিয়েছেন। বহরে রয়েছে খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী।
ইসরায়েলের বাধার ঘটনায় ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং কয়েকটি রাষ্ট্র নিন্দা জানিয়েছে। মালয়েশিয়া সরকার স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, “গাজার উদ্দেশে যাওয়া ত্রাণবাহী বহরে হামলার পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমন পদক্ষেপ বন্ধ না হলে এর ফল ভয়াবহ হবে।”
এছাড়া ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক মানবাধিকার সংগঠন জরুরি বৈঠক আহ্বান করেছে। সামাজিক মাধ্যমে বহু মানুষ ইসরায়েলের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
সব বাধা সত্ত্বেও ফ্লোটিলা কর্তৃপক্ষ বুধবার স্থানীয় সময় বিকালে জানিয়েছে, তারা গাজার উপকূল থেকে ৯০ নটিক্যাল মাইলেরও কম দূরত্বে রয়েছে। বহরের প্রত্যাশা, বৃহস্পতিবার সকালে তারা গাজার উপকূলরেখায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে। তবে ইসরায়েলের নৌবাহিনী আবারো বাধা দিলে একটি বড় সংঘর্ষের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গাজায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুদ্ধ, খাদ্য সংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত এই ত্রাণবাহী নৌবহর ফিলিস্তিনিদের জন্য এক আশার আলো হয়ে এসেছে। কিন্তু ইসরায়েলের পুনরাবৃত্ত বাধা এবং যুদ্ধজাহাজের আগ্রাসী কৌশল বিশ্ববাসীর কাছে আবারো সেই প্রশ্ন তুলে ধরেছে—মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়াও কি এখন অপরাধ?
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা শেষ পর্যন্ত গাজায় পৌঁছাতে পারবে কি না, তা সবার নজর এখন সেদিকেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ