
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে আবারও বড় আলোচনার জন্ম দিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ভার্জিনিয়ার কোয়ান্টিকোতে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের এক বিশেষ বৈঠকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতিকে সরাসরি ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সতর্কতা জারি করেছেন। অপরাধ, অভিবাসন সংকট এবং রাজনৈতিক বিভাজনকে তিনি দেশের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেন।
প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেন— “আমরা এখন এমন এক যুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছি, যা বাইরের নয় বরং ভেতর থেকে আসছে। অপরাধ আর অভিবাসনের মতো ইস্যু আমাদের ভেতরেই এক অশান্তির জন্ম দিচ্ছে। এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, না হলে পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবে।”
পেন্টাগন প্রধান পিট হেগসেথের আহ্বানে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বিশ্বজুড়ে থেকে আসা মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল, অ্যাডমিরাল এবং বিশেষ ইউনিটের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিশাল আমেরিকান পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, তিনি একটি নতুন নির্দেশে স্বাক্ষর করেছেন, যার মাধ্যমে সেনাবাহিনী একটি দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর বিশেষ বাহিনী গঠন করবে। এই বাহিনী মূলত ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ মোকাবিলায় দায়িত্ব পালন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা সাধারণত সেনাদের উদ্দেশ্যে ভাষণে রাজনৈতিক ইস্যু এড়িয়ে যান। কিন্তু ট্রাম্প ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি সরাসরি ডেমোক্র্যাট-শাসিত শহরগুলোর সমালোচনা করেন। তার মতে, ওইসব শহরে অপরাধ ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, আর সেনাদের দায়িত্ব হবে এগুলো দমন করা। “আমরা একে একে তাদের ঠিক করব। এই কক্ষে উপস্থিত কিছু মানুষের জন্য এটি হবে বড় দায়িত্ব,” বলেন ট্রাম্প।
তিনি এ সময় গণমাধ্যমকেও আক্রমণ করেন এবং সাংবাদিকদের ‘অসৎ লোক’ বলে অভিহিত করেন। তার বক্তব্যের প্রায় অর্ধেকই ছিল রাজনৈতিক সমালোচনা ও দলীয় এজেন্ডার প্রতিফলন, যা একেবারেই অপ্রচলিত ঘটনা। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, সামরিক কর্মকর্তাদের সামনে এমন বক্তব্য দেশটির গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য নতুন বিতর্ক তৈরি করবে।
বক্তৃতার সময় উপস্থিত শীর্ষ জেনারেল ও অ্যাডমিরালরা নীরব ছিলেন। তারা ট্রাম্পের মন্তব্যের সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সবসময়ই বিতর্ক থাকে। সমালোচকেরা আশঙ্কা করছেন, প্রেসিডেন্টের এই নির্দেশ কার্যকর হলে ‘সামরিকীকৃত আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বক্তৃতার শুরুতে ট্রাম্প সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন। তিনি বলেন— “আমাদের সেনারা এখন যোদ্ধার চেতনা পুনর্জাগরিত করছে। তারা প্রস্তুত, সক্ষম এবং শক্তিশালী।” তবে শিগগিরই তিনি রাজনৈতিক সুরে চলে যান এবং মার্কিন অভ্যন্তরীণ সংকটকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই ভাষণ কেবল সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্য নয়, বরং এটি তার রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল। ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শুরু করেছেন রিপাবলিকান নেতারা, আর ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড তার প্রার্থিতাকে ঘিরে আলোচনার আগুন আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ওয়াশিংটনের জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক হেনরি লুইস বলেন, “ট্রাম্প খুব সচেতনভাবে সামরিক কর্মকর্তাদের সামনে রাজনৈতিক ভাষণ দিয়েছেন। তিনি সেনাদের সঙ্গে জননিরাপত্তার ইস্যুকে মেলাতে চাইছেন, যা আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত।”
ট্রাম্পের এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সমর্থকেরা মনে করছেন, তিনি দেশকে ভেতর থেকে ধ্বংসকারী সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী ও সমালোচকেরা বলছেন, এটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার এক ধরনের প্রচেষ্টা।
একাধিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, সেনাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ব্যবহার করা হলে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে। তাদের মতে, ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ সংজ্ঞাটি অস্পষ্ট, আর এই অস্পষ্টতাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করা হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণ শুধু সেনা কর্মকর্তাদের জন্য দেওয়া বক্তব্য নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে নাড়া দিয়েছে। অপরাধ ও অভিবাসনকে কেন্দ্র করে তিনি যে ‘অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা আগামী দিনগুলোতে দেশটির রাজনীতি, নীতি এবং সামরিক কৌশলে নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ