
ছবি: সংগৃহীত
আফগানিস্তানজুড়ে হঠাৎ করেই স্থবির হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক। মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) থেকে দেশটিতে কার্যত সম্পূর্ণ ডিজিটাল ব্ল্যাকআউট নেমে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা যেমন হঠাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোও নিশ্চিত করেছে যে আফগানিস্তানে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে।
তালেবান প্রশাসন তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এ পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষত অনলাইন কনটেন্ট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘অনৈতিক কর্মকাণ্ড’ প্রতিরোধের চেষ্টা।
লন্ডনভিত্তিক ইন্টারনেট পর্যবেক্ষণ সংস্থা নেটব্লকস জানিয়েছে, আফগানিস্তানে ইন্টারনেট সংযোগ মঙ্গলবারের মধ্যে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সংযোগ মাত্র ১ শতাংশে নেমে আসে।
তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, “সোমবার থেকেই পর্যায়ক্রমে সংযোগ বন্ধ করা হচ্ছিল। এর চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে টেলিফোন পরিষেবাতেও প্রভাব পড়েছে।”
এই পরিস্থিতিকে তারা অভিহিত করেছে ‘সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট’ হিসেবে, যা আফগানিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঘটছে।
আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই তালেবান সরকার অনলাইন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
-
তারা পূর্বে অনলাইন পর্নোগ্রাফি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘অনৈতিক ব্যবহার’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
-
কিছু প্রদেশে আগে থেকেই ফাইবার অপটিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।
-
চলতি মাসের শুরুতে বালখ প্রদেশের তালেবান মুখপাত্র জানান, ‘‘নেতৃত্বের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে পাপ প্রতিরোধের জন্য।’’
তিনি দাবি করেছিলেন, সংযোগের চাহিদা পূরণে দেশজুড়ে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
দেশটির জনপ্রিয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোলো নিউজ জানায়, তাদের সম্প্রচার এবং অনলাইন পরিষেবাতেও বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটি দর্শকদের সতর্ক করে বলেছে, মোবাইল ফোনের থ্রি-জি ও ফোর-জি পরিষেবা বন্ধ করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ এক সপ্তাহের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে, কেবল পুরনো টু-জি স্ট্যান্ডার্ড সক্রিয় থাকবে।
এটি কার্যকর হলে শুধু সাধারণ জনগণই নয়, সরকারি কার্যক্রম এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রথমে কয়েকটি প্রদেশে ইন্টারনেট সীমিত করা হয়েছিল।
-
উত্তরাঞ্চলের বাদাখশান ও তাখর,
-
দক্ষিণের কান্দাহার, হেলমান্দ, নাঙ্গারহার ও উরুজগান প্রদেশে আগে থেকেই ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে ছিল।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এবার তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে পুরো দেশই ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতার মধ্যে চলে গেছে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, তালেবানরা কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে ফাইবার অপটিক কেবল বিচ্ছিন্ন করছিল অপরাধ মোকাবিলা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর অজুহাতে। সর্বশেষ ধাপে গিয়ে তারা একযোগে দেশজুড়ে সংযোগ বন্ধ করেছে।
রয়টার্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অতীতে তালেবান প্রশাসন পর্নোগ্রাফি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নৈতিকতা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বিভিন্ন অঞ্চলে আংশিকভাবে সংযোগ বন্ধ করেছিল। তবে এবার প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ আফগানিস্তানজুড়ে ব্ল্যাকআউট কার্যকর হলো।
প্রযুক্তি ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেট ও আধুনিক টেলিযোগাযোগ ছাড়া একটি দেশ কার্যত আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
-
অর্থনৈতিক ক্ষতি: ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
-
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: অনলাইন শিক্ষা ও তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। চিকিৎসা খাতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিঘ্নিত হবে।
-
জনগণের দুর্ভোগ: সাধারণ মানুষ বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ হারাচ্ছেন। রেমিট্যান্স নির্ভর পরিবারগুলো হুন্ডি চক্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।
২০২১ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে তালেবান সরকার তাদের ইসলামী ব্যাখ্যা অনুযায়ী সামাজিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছে।
-
মেয়েদের শিক্ষায় বিধিনিষেধ,
-
নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে বাধা,
-
বিনোদন ও সংস্কৃতি খাতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ—
এসবের সঙ্গে এবার যোগ হলো ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণের সর্বোচ্চ রূপ। পর্যবেক্ষকদের মতে, এর ফলে আফগান জনগণ আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশটির অবস্থান দুর্বল হবে।
আফগানিস্তানে একযোগে ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধের এই পদক্ষেপ দেশটির জন্য শুধু প্রযুক্তিগত নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক মহল বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তালেবান প্রশাসন এখনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়নি। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যদি দ্রুত সমাধান না আসে, তবে আফগানিস্তান কার্যত ২১শ শতকের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ‘অন্ধকার দ্বীপে’ পরিণত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ