
ছবি: সংগৃহীত
ঘরের রান্নাঘর থেকে শুরু করে যানবাহন চলাচল পর্যন্ত দেশের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে এলপি গ্যাস ও অটোগ্যাস। বিশ্ববাজারের মূল্য ও ডলারের বিনিময় হারভিত্তিক জ্বালানির এই মূল্য নির্ধারণে প্রতি মাসেই আসে পরিবর্তন। এবার ২০২৫ সালের মে মাসের জন্য আবারও স্বস্তির খবর নিয়ে এলো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
রোববার (৪ মে) বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিইআরসি ঘোষণা দেয়, মে মাসের জন্য দেশে ভোক্তাপর্যায়ে ব্যবহৃত এলপিজি (লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস)–এর দাম সামান্য হারে কমানো হয়েছে। নতুন দাম অনুযায়ী, ১২ কেজির একটি স্ট্যান্ডার্ড সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে ১৯ টাকা কমিয়ে ১ হাজার ৪৩১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই মূল্য আজ রোববার সন্ধ্যা থেকেই কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বিইআরসি।
মূল্য কমার বিস্তারিত
গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের পাশাপাশি যানবাহনে ব্যবহৃত অটোগ্যাসের দামেও এসেছে সামান্য পরিবর্তন। নতুন ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভোক্তাপর্যায়ে অটোগ্যাসের দাম প্রতি লিটার ৬৬ টাকা ৪১ পয়সা থেকে কমিয়ে ৬৫ টাকা ৫৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি লিটারে ৮৪ পয়সা কমানো হয়েছে।
মূল্য নির্ধারণে বিইআরসি আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের প্রাইস ইনডেক্স—বিশেষত সৌদি আরব ভিত্তিক সৌদি আরামকোর নির্ধারিত CP (Contract Price) অনুযায়ী প্রতি মাসে সমন্বয় করে থাকে। সেই সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয় ডলারের রেট, পরিবহন ব্যয়, প্যাকেজিং খরচ এবং মুনাফার হার।
গত মাসগুলোর দাম পর্যালোচনা
চলতি বছর ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত এলপি গ্যাসের দামে কয়েক দফা পরিবর্তন এসেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১৯ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৭৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে মার্চ মাসে ২৮ টাকা কমিয়ে সেই দাম নেমে আসে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়। তবে এপ্রিল মাসে দাম অপরিবর্তিত রেখে সেই মূল্যেই বাজার চলেছে। অবশেষে মে মাসে এসে আবার ১৯ টাকা কমিয়ে গ্যাসের দাম ১ হাজার ৪৩১ টাকায় নামিয়ে আনা হলো।
এভাবে প্রতি মাসের শুরুতেই নতুন মূল্য ঘোষণা করা বিইআরসি’র একটি রুটিন কার্যক্রম। এতে করে ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা সময়মতো দাম পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিতে পারেন। তবে প্রতি মাসে দামের এই উঠানামা অনেক সময় ভোক্তাদের জন্য বিভ্রান্তির কারণও হয়ে দাঁড়ায়।
সরকারি বিবৃতি ও জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া
বিইআরসি জানায়, বিশ্ববাজারে এলপি গ্যাসের আমদানি মূল্য কিছুটা কমেছে, একই সঙ্গে ডলারের বিনিময় হারেও সামান্য স্থিতিশীলতা এসেছে। ফলে সামগ্রিক হিসাব অনুযায়ী দাম হ্রাসের যৌক্তিকতা পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দাম কিছুটা কমায় অনেক ভোক্তাই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। মোহাম্মদপুরের এক গৃহবধূ সুমনা বলেন, “প্রতি মাসে গ্যাসের দাম বাড়তে থাকলে সংসারের বাজেটে চাপ পড়ে। এখন একটু কমেছে শুনে ভালো লাগছে। যদিও এটা খুব বড় পরিমাণ না, তবু সবকিছুতেই এখন একটু কম দামে কিছু পাওয়া স্বস্তির।”
তবে বেশ কিছু খুচরা বিক্রেতা বলছেন, সরকারি ঘোষণা দ্রুত কার্যকর হলেও পাইকারি পর্যায়ে দাম কমতে দেরি হয়, ফলে অনেক সময় তারা পুরোনো দামে গ্যাস কিনে নতুন দামে বিক্রি করতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়েন।
গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া কীভাবে হয়?
বাংলাদেশে এলপি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করে থাকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (BERC)। প্রতি মাসে সৌদি আরবের আরামকো কোম্পানির ঘোষিত CP (Contract Price) এর ভিত্তিতে আমদানি মূল্য পুনর্মূল্যায়ন করে দেশীয় বাজারে দাম নির্ধারণ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পরিবহন ব্যয়, মজুদ খরচ, মার্কেটিং খরচ, ডলার রেট, মুনাফার হারসহ বিভিন্ন উপাদান বিবেচনায় নেওয়া হয়।
অটোগ্যাসের মূল্য পরিবর্তনের প্রভাব
বর্তমানে সিএনজি স্টেশনগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন গ্যাস স্টেশনগুলোতেও অটোগ্যাস ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। যাত্রী পরিবহন খাত, পরিবহন মালিক সমিতি এবং রাইডশেয়ারিং প্ল্যাটফর্মের চালকরা অটোগ্যাসের দামে সামান্য পরিবর্তনকেও গুরুত্বের সঙ্গে নেন। কারণ জ্বালানির খরচ তাদের আয়ের বড় একটি অংশ নির্ধারণ করে।
একজন রাইডশেয়ারিং চালক আইমান বলেন, “লিটারপ্রতি ৮৪ পয়সা কমলে দিনে অন্তত ১০ লিটার খরচে ৮ টাকার মতো সাশ্রয় হবে। মাসে তা দাঁড়াবে আড়াই শতাধিক টাকা। ছোট মনে হলেও আমাদের জন্য এই অঙ্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও বাজারে প্রভাব
যদিও এবারের দাম হ্রাস তুলনামূলকভাবে সীমিত, তবে এটি কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়ের চাপে থাকা সাধারণ মানুষের জন্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে সরকারকে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজস্ব উৎপাদন ও রিজার্ভ সিস্টেম আরও জোরদার করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, গ্যাসের মূল্য সরাসরি কৃষি, পরিবহন এবং ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে জড়িত। তাই প্রতিমাসে এই মূল্য পরিবর্তনের বিষয়টিকে কেবল ভোক্তাপর্যায়ের স্বস্তি নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতির সূচকের একটি স্পর্শকাতর দিক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
মে মাসের জন্য এলপি গ্যাস ও অটোগ্যাসের সামান্য মূল্য হ্রাস দেশের জনগণের জন্য সাময়িক স্বস্তির বার্তা বয়ে এনেছে। তবে এই স্বস্তি টেকসই করার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারের ঝুঁকি মোকাবেলায় কৌশলী প্রস্তুতি। মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা, বাজারে কার্যকর নজরদারি এবং ব্যবসায়ী-ভোক্তা উভয়ের সমন্বয়ে গ্যাস খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ