
মোয়াজ্জেম হোসেন ও মুহাম্মদ তুহিন ফারাবী। ছবি:সংগৃহীত
উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের ঘনিষ্ঠ সহকারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাম্প্রতিক পদক্ষেপ। সরকারি প্রভাবশালী দপ্তরে দায়িত্ব পালনকারী এসব সহকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ, তদবির বাণিজ্য ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে এবার আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধানে নামছে সংস্থাটি।
বিশেষ করে যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) হিসেবে দায়িত্বে থাকা ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবির নাম এখন তদন্তের কেন্দ্রে। একইসঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ডা. মাহমুদুল হাসানের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
এই অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে রোববার (৪ মে) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমিশনের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন— “গণমাধ্যমে যেসব তথ্য এসেছে, সেগুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাইয়ের পর কমিশনের অনুমোদনক্রমে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রমাণ মিললে ছাড় দেওয়া হবে না।”
উল্লেখ্য, কয়েক সপ্তাহ আগে দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলোতে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাদের দপ্তরে নিয়োজিত এসব এপিএস ও পিও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন নিয়োগ, বদলি, প্রকল্প অনুমোদন এবং আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নামে তদবির বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা একটি অনানুষ্ঠানিক সিন্ডিকেট শত কোটি টাকা ঘুষ ও অবৈধ সুবিধা আদান-প্রদানের মাধ্যমে লাভ করেছে।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই বিষয়টি দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও গণমাধ্যম মহলে আলোচনার জন্ম দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ এপ্রিল একটি ব্রিফিংয়ে দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন প্রথমবারের মতো জানান, তারা এই অভিযোগগুলো অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে অনুসন্ধান শুরুর আগে প্রাথমিকভাবে অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা, তথ্য-প্রমাণ এবং আইনি ভিত্তি যাচাই করে দেখা হবে।
দুদকের অভ্যন্তরীণ নিয়ম অনুযায়ী, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, জনসাধারণের দেওয়া অভিযোগ কিংবা সরকারী দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রথমে তা "ভেরিফিকেশন অ্যান্ড স্ক্রুটিনি সেল"–এ পাঠানো হয়। সেখান থেকে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হয় এবং কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে অভিযোগটি পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানে পরিণত হয়।
মহাপরিচালক বলেন— “আমরা চাই না কারো বিরুদ্ধে অযাচিত হয়রানি হোক। তবে, যদি প্রমাণ মেলে যে তারা সরকারি অবস্থান ব্যবহার করে অবৈধভাবে সম্পদ গড়েছেন, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তবে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
দুদকের অনুসন্ধানের আগেই প্রশাসনিকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২২ এপ্রিল জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব মোয়াজ্জেম হোসেনকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে জানা গেছে, উপদেষ্টা তাকে অব্যাহতির নির্দেশ দিয়েছিলেন ৮ এপ্রিলেই।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের পিও হিসেবে নিয়োজিত ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবির বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠার পর তাকে আগেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে দুজনই তরুণ এবং শিক্ষার্থী পরিচয়ধারী হলেও, দায়িত্বকালে বিপুল প্রভাব খাটিয়ে থাকতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই ঘটনার পর রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে, উপদেষ্টাদের এমন ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরকে কীভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়া এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল? প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উপদেষ্টা বা রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অধীনে থাকা ব্যক্তিদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট আইন ও নির্দেশনার অভাবেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দুদকের এ অনুসন্ধান যদি প্রমাণসহ পূর্ণাঙ্গ তদন্তে রূপ নেয়, তাহলে এটি প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ নজির হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যদি অনুসন্ধানে দুর্নীতির পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ ধরনের মামলায় সরকারি চাকরি আইনের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ গঠন করে চার্জশিট দাখিল করা হতে পারে। এছাড়া অবৈধ সম্পদের উৎস ব্যাখ্যা করতে না পারলে সম্পদ জব্দসহ দণ্ডের মুখোমুখিও হতে পারেন অভিযুক্তরা।
সরকারি পদমর্যাদার আড়ালে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির বাণিজ্য এবং জনসেবাকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা তদন্তের মাধ্যমে নিরসন করা না গেলে ভবিষ্যতে এটি নীতিগত সংকট তৈরি করবে। তাই দুদকের এই অনুসন্ধান কেবল ব্যক্তি নয়, বরং পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর স্বচ্ছতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি পরীক্ষাও বটে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ