ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কার্যক্রম, নীতিনির্ধারণ এবং স্বচ্ছতা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী একটি পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছরে গণমাধ্যমগুলোর যে কার্যক্রম ও আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে, তা এখন একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা জরুরি। বিশেষ করে স্বৈরাচার সরকারের সময় যারা গণমাধ্যম পরিচালনা করেছেন, তাদের ভূমিকা মূল্যায়ন করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রোববার (৪ মে) বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর আয়োজনে রাজধানীর ধানমণ্ডির টিআইবি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বিশেষ আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। মাহফুজ আলম বলেন, “বাংলাদেশের মিডিয়ায় এখন জবাবদিহিতার ঘাটতি আছে। গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী স্তম্ভ হলেও এখানে অ্যাকাউন্টেবিলিটির চর্চা অত্যন্ত দুর্বল। অনেক হাউস রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যার ফল ভোগ করছেন নিজেরাই—সাংবাদিকরা।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বেতার, বিটিভি ও বাসসকে একীভূত করে একটি জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা গঠন করা দরকার। এতে করে সরকারের মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো আরও সংগঠিত ও জবাবদিহিমূলক হবে। একইসাথে সরকারি বিজ্ঞাপন বাবদ মূল্যের নির্ধারণও হওয়া জরুরি, যাতে অযোগ্য ও অব্যবস্থাপনায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো অব্যাহত সুবিধা না পায়।”
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা জানান, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাপনার জন্য ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্মস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স (ডিএফপি)-এর সঙ্গে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্ক ফোর্সের কাজ হবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রদানের মানদণ্ড, মূল্য নির্ধারণ এবং লাইসেন্স নবায়ন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা। তিনি বলেন, “আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অধিকাংশ গণমাধ্যম হাউসের রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দেওয়ার মতো নীতিমালাও নেই, কিংবা তারা এই বিষয়ে দায়িত্বশীল নয়। অথচ রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিতে তারা সবসময় অগ্রগামী।”
আলোচনা সভায় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান সাংবাদিক কামাল আহমেদ বলেন, সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা গেলে সংবাদকর্মীদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, “সাংবাদিকরা যদি অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন থাকেন, তাহলে তারা বাধ্য হন নানা অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে। আর এটাই সাংবাদিকতার মর্যাদাহানি ঘটায়।”
তিনি আরও বলেন, “যারা সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন নবম গ্রেডে নির্ধারণ করা অসম্ভব বলছে, তারা প্রকৃতপক্ষে কর্মীদের ন্যায্য বেতন না দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে লাভবান হতে চায়। এর মাধ্যমে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নয়, বরং ব্যবসায়িক সুবিধা নিশ্চিত করতে বেশি মনোযোগী।”
অনুষ্ঠানে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সম্প্রতি নারী সংস্কার কমিশনকে ঘিরে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে যেসব কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য হয়েছে, তা রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মিলিত মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সরকার এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে।”
তিনি আরও বলেন, “গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে শুধু প্রকাশের অধিকার নয়, বরং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল সুরক্ষা এবং সংবেদনশীল বিষয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত। যখন সেই দায়িত্বহীনতা আসে, তখন পুরো মিডিয়া পরিবেশই বিপন্ন হয়ে পড়ে।”
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য বক্তারাও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের গত ১৫ বছরের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বলেন যে, এমন একটি সময়ে মিডিয়ার পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতা পুনর্গঠনের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি, যখন দেশে ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহের গতিশীলতা বাড়ছে।
মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে আয়োজিত এই আলোচনায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা থেকে পরিষ্কার—বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে আরও জবাবদিহিমূলক ও সুশৃঙ্খল করতে হলে সরকার, সংবাদ সংস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের একসাথে কাজ করতে হবে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গণমাধ্যম হাউসগুলোর নীতি ও আচরণগত সংস্কারও এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



