
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রপ্তানি খাত দীর্ঘদিন ধরেই তৈরি পোশাকনির্ভর। তৈরি পোশাক থেকেই আসে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ। অথচ সরকারের নানা উদ্যোগ ও প্রণোদনার পরও রপ্তানি বহুমুখীকরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষ করে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হলে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ডলারের। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিই ৩ হাজার ২৫ কোটি ডলার, অর্থাৎ একক খাত থেকেই এসেছে মোট রপ্তানির প্রায় ৮১ শতাংশ। মার্চ মাসেই পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৪৫ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। এর পরবর্তী রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, যার আয় ৯ মাসে মাত্র ৮৫ কোটি ডলার।
এই বিশাল ব্যবধান রপ্তানি বৈচিত্র্যহীনতার বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি খাত চামড়াজাত পণ্য আর তৃতীয় স্থানে থাকা কৃষিপণ্যও অনেক পিছিয়ে—যেখানে কৃষিপণ্য রপ্তানি ৯ মাসে ৮১ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। তবে মার্চ মাসে এই খাতে ২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, যা রপ্তানি স্থিতিশীলতার প্রশ্ন তোলে।
এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক পণ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিকে বড় বিপদের মুখে ফেলতে পারে। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বিভিন্ন পণ্যের ওপর আন্তর্জাতিক শুল্ক, কোটার সুবিধা উঠে যাবে। সেই প্রেক্ষাপটে নতুন বাজার খোঁজা এবং নতুন পণ্য উদ্ভাবনের বিকল্প নেই।
রপ্তানি বিশ্লেষক ও এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসির বলেন, “আমাদের এখনই রপ্তানি বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। বিদেশে প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি। শুধু প্রণোদনা দিলেই হবে না, করপোরেট ট্যাক্স কমাতে হবে, প্রক্রিয়াগত জটিলতা দূর করতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে রপ্তানি বহুমুখীকরণে সফল হয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।”
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমাদের রপ্তানি এখনও একটি নির্দিষ্ট খাত বা পণ্যের ওপর অতি নির্ভরশীল। এটি একটি বড় ঝুঁকি। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে উদ্ভাবন ও নতুন বাজারের সন্ধান করতে হবে। একইসঙ্গে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য সরকার প্রস্তুত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করা হবে।”
রপ্তানিকারকদের সংগঠনগুলোর দাবি, দেশে নীতিনির্ধারণী অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা নতুন খাতে রপ্তানি বৃদ্ধির পথে প্রধান বাধা। পাট, প্লাস্টিক, প্রকৌশল ও হোম টেক্সটাইল খাতে সম্ভাবনা থাকলেও প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনার অভাবে এগুলো তেমন গতি পাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এক পণ্যের ওপর বেশি নির্ভর করে যারা এলডিসি থেকে উত্তরণ করেছে, তারা অনেকেই পরে রপ্তানি হঠাৎ কমে যাওয়ায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছে। যেমন আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলো। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি হতে পারে যদি এখনই বিকল্প বাজার ও পণ্যনির্ভর রপ্তানি কাঠামো গড়ে তোলা না যায়।
এই বাস্তবতায় রপ্তানি বহুমুখীকরণ শুধু একটি অর্থনৈতিক বিকল্প নয়—বরং এটি হয়ে উঠেছে একটি জাতীয় জরুরি নীতি। অর্থনীতি বাঁচাতে এখনই প্রয়োজন পরিপূর্ণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা, টেকসই নীতি সহায়তা এবং উদ্যোক্তাদের জন্য বাস্তবসম্মত সহায়তা কাঠামো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ