
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ঋণচুক্তির আওতায় বাকি কিস্তির অর্থ ছাড় নিয়ে যখন নানা আলোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশ সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন—যদি সংস্থাটি অতিরিক্ত শর্তারোপ করে, তবে বাংলাদেশ এ ঋণচুক্তি থেকে সরে আসতে পারে।
শনিবার (৩ মে) রাজধানীর ফার্মগেটস্থ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে (বিএআরসি) আয়োজিত বাজেট বিষয়ক এক সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এই কথা বলেন। তার এই বক্তব্যটি এমন এক সময় এলো, যখন আইএমএফ-এর চতুর্থ কিস্তি ছাড় নিয়ে সরকারি মহলে উদ্বেগ এবং বিভিন্ন মহলে চাপ স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও টেকসই অর্থনীতি গড়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আইএমএফ যদি এমন শর্ত দেয়, যেগুলো মেনে চললে আমাদের অর্থনীতি আরও সংকটে পড়ে যাবে, তবে আমরা সেই পথে যাব না। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এই সময়ে কঠিন শর্ত মেনে নেওয়া যৌক্তিক হবে না। প্রয়োজন হলে আমরা বিকল্প পথ খুঁজে নেব।”
তিনি আরও বলেন, "একটি দেশ যখন উন্নয়নশীলের কাতারে উঠতে চায়, তখন অর্থনীতির ভিত শক্ত রাখা অপরিহার্য। এ জন্য আমরা কৃষিতে গুরুত্ব দিচ্ছি, যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে পারে। আইএমএফ-এর অতিরিক্ত শর্ত আমাদের কাঙ্ক্ষিত এই অভিযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে।"
কৃষি অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ
সেমিনারে উপস্থিত কৃষি অর্থনীতিবিদরা বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। তারা বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া পোল্ট্রি ফিড তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট-শুল্ক কমানো এবং খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাবও উঠে আসে আলোচনায়।
তারা বলেন, সরকার যদি সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেয়, তবে কৃষি খাত তার সম্ভাবনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারবে না। এতে দেশের খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়বে এবং রিজার্ভের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হবে।
আইএমএফ চুক্তির প্রেক্ষাপট
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ-এর সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী মোট ছয় কিস্তিতে এই ঋণ ছাড় করার কথা। এরই মধ্যে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির আওতায় ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার, ১৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তিতে ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ২৪ জুন তৃতীয় কিস্তিতে ১১৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ পেয়েছে।
তবে বাকি তিন কিস্তি, বিশেষ করে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে যেসব অর্থনৈতিক সংস্কারমূলক শর্ত দেওয়া হচ্ছে—যেমন ভ্যাট সংস্কার, ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা, ডলারের বাজার মূল্য বাস্তবায়ন, রপ্তানির আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে ফেরত আনা ইত্যাদি—তা পূরণে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সময়মতো সাড়া দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ চতুর্থ কিস্তি ছাড়ে বিলম্ব করছে এবং এমনকি নতুন শর্ত সংযোজনের কথাও বলছে। এর বিপরীতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এখন স্পষ্ট বার্তা আসছে যে, অতিরিক্ত শর্ত চাপিয়ে দিলে বাংলাদেশ বিকল্প চিন্তা করতে পারে।
বিকল্প ভাবনার ইঙ্গিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, সরকার হয়তো কৌশলগতভাবে আইএমএফ-এর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প উৎস যেমন বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) কিংবা দ্বিপক্ষীয় ঋণদানকারী দেশগুলোর দিকে ঝুঁকতে পারে। তুরস্ক, চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে কিছু দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা আলোচনা ইতিমধ্যেই চলছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে, আইএমএফ ঋণ একমাত্র সমাধান নয়। এই বক্তব্যের প্রতিফলন আনিসুজ্জামান চৌধুরীর ভাষণেও ছিল স্পষ্ট।
চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার সঙ্গে কৌশলী সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তবে তার জন্য জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আপস করা যাবে না—এই বার্তাই এবার স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন সরকার সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ