
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্ত ঘেঁষা লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার গাটিয়ারভিটা সীমান্তে বাংলাদেশি দুই যুবককে আটক করে ফেরত দিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। শুক্রবার সন্ধ্যায় চা বাগানে প্রবেশ করে ভিডিও ধারণের সময় বিএসএফ তাদের আটক করে। পরে মধ্যরাতে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে দুই যুবককে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়।
এই ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে সীমান্ত এলাকায় কিশোর-তরুণদের অসাবধানতাবশত সীমান্ত লঙ্ঘনের প্রবণতা, এর বিপজ্জনক পরিণতি এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলোর ভূমিকা।
প্রাথমিক তথ্যমতে, শুক্রবার (২ মে) সন্ধ্যা ৬টার দিকে পাটগ্রাম উপজেলার গাটিয়ারভিটা সীমান্তের মেইন বর্ডার পিলার ৮২৫ এর সাব-পিলার ১-এস এর কাছে দুই বাংলাদেশি যুবক— মাহফুজ ইসলাম ইমন (১৭) ও সাজেদুল ইসলাম (২০)— হঠাৎ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্তবর্তী একটি চা বাগানে প্রবেশ করেন। তারা সেখানে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণে ব্যস্ত ছিলেন, যা তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ করে টিকটকে প্রকাশের উদ্দেশ্যে করছিলেন বলে জানায় স্থানীয়রা।
ইমন এসএসসি পরীক্ষার্থী। সে পাটগ্রাম উপজেলার রহমতপুর হাটিয়ারভিটা গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফিজ রহমানের ছেলে। অপর যুবক সাজেদুল ইসলাম বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলামের ছেলে। তারা সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে।
ইমন ও সাজেদুল স্থানীয়দের জানান, তাদের কোনো বেআইনি উদ্দেশ্য ছিল না। কেবলমাত্র বাগানের দৃশ্য দেখে মোবাইলে ছবি ও ভিডিও তুলছিলেন তারা। এ সময় টহলরত বিএসএফ সদস্যরা তাদের সন্দেহজনক মনে করে আটক করে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
ঘটনার পরপরই গাটিয়ারভিটা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টি লক্ষ্য করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে ধবলসুতি বিওপি ক্যাম্পে কর্মরত ৬১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সদস্যদের অবহিত করেন। বিজিবির পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি যোগাযোগ করা হয় সীমান্তের ওপারে বিএসএফের সঙ্গে।
বিজিবি এবং বিএসএফের মধ্যে এ বিষয়ে তথ্য যাচাই ও আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ শুরু হয়। রংপুর সেক্টরের বিজিবি কমান্ডার এবং জলপাইগুড়ি সেক্টরের বিএসএফ কমান্ডারের মধ্যে যোগাযোগের পর উভয়পক্ষ পতাকা বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়।
শনিবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে ধবলসুতি সীমান্তে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ের এই বৈঠক হয় গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বৈঠকে বিএসএফ পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা আটক দুই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েছেন— এদের উদ্দেশ্য অনুপ্রবেশ বা গোয়েন্দাগিরি নয়, বরং তারা পরিস্থিতির গুরুত্ব না জেনেই ভুলবশত সীমান্ত অতিক্রম করেছেন।
বিজিবি ধবলসুতি ক্যাম্পের কমান্ডার নায়েক সুবেদার মোক্তার হোসেন পতাকা বৈঠক শেষে বলেন, “আমরা বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত পতাকা বৈঠকের ব্যবস্থা করি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে। রাতেই আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে আটক দুই বাংলাদেশি যুবককে হস্তান্তর করে তারা। পরে আমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিই।”
পাটগ্রামের ফিরিয়ে আনা যুবক সাজেদুল ইসলাম বলেন, “আমরা বুঝতে পারিনি যে এটা ভারতের ভেতরে চলে গেছি। চা বাগানটা দেখতে সুন্দর লাগছিল, তাই ভিডিও করছিলাম। হঠাৎ কয়েকজন বিএসএফ সদস্য আমাদের ধরে নেয়। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। ওনারা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর শান্ত হলেন।”
ইমন বলেন, “আমি পরীক্ষার্থী। এমন একটা ভুল জীবনে আর করব না। আমার মা-বাবা খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে ও বিজিবির কারণে আমরা বাড়ি ফিরতে পেরেছি।”
সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী যুবসমাজের মধ্যে সচেতনতা ও সতর্কতার অভাব যে কী পরিমাণ বিপদের সৃষ্টি করতে পারে, এই ঘটনাটি তার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। সীমান্ত অতিক্রমের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে যে কিশোর-তরুণরা কতটা অবগত নয়, তা থেকে বোঝা যায়— সীমান্তবর্তী গ্রামে নিয়মিত সচেতনতা কর্মসূচির প্রয়োজন রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক শামীম আহমেদ বলেন, “এই ঘটনাটি নিছক মজার ছলে হলেও, এতে আন্তর্জাতিক আইন এবং নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। সীমান্তবর্তী এলাকায় স্কুলভিত্তিক সচেতনতা কর্মসূচি, মোবাইল ফোন ব্যবহারের দিকনির্দেশনা, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট তৈরির সীমারেখা স্পষ্ট করে দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সীমান্ত এলাকায় এমন ভুলচুক অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। অতীতে বিএসএফ অনেক ঘটনায় গুলি চালিয়েছে। এবারের মতো সবসময় সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান নাও হতে পারে।”
সীমান্ত এলাকায় এমন অনুপ্রবেশমূলক ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে থাকে। কখনও তা হয় চোরাচালানিদের মাধ্যমে, কখনও বা হয় অসচেতন স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বারা। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবুও সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক, মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে।
বিজিবির রংপুর সেক্টরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “আমরা সীমান্ত এলাকায় পোস্টার, মাইকিং, সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করে থাকি। কিন্তু এখন সময় এসেছে স্কুল পর্যায়ে ‘সীমান্ত শিক্ষা কর্মসূচি’ চালুর। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনকেও ভূমিকা রাখতে হবে।”
পাটগ্রামের গাটিয়ারভিটা সীমান্তে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি সতর্কবার্তা। যুবসমাজের কৌতূহল ও প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড যাতে সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের পর্যায়ে না পৌঁছে— সে বিষয়ে অভিভাবক, শিক্ষক ও প্রশাসনের যৌথ দায়িত্ব রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সীমান্তে সচেতনতা ও নিয়ম মেনে চলাই শুধু নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, একইসঙ্গে এটি দুই দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার পূর্বশর্তও।
বাংলাবার্তা/এমএইচ