
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় হাইকোর্টে বহাল রাখার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি অবশেষে প্রকাশিত হয়েছে। ১৩১ পৃষ্ঠার এই পূর্ণাঙ্গ রায় গত মার্চে ঘোষণা করা হলেও ৩ মে (শনিবার) তা প্রকাশ পায়। এতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং আরও ৫ জনের যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশের রায় আগের মতোই বহাল রাখা হয়েছে।
রায়ের প্রেক্ষাপট
এই মামলার রায় দেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ের দিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের নেতৃত্ব দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জসিম সরকারসহ অন্যান্য আইনজীবীরা। একইসঙ্গে আসামিপক্ষের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, শিশির মনির প্রমুখ।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ ও ভাই আবরার ফাইয়াজ, যারা রায়ের স্থায়িত্ব ও ন্যায়বিচারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা আশা প্রকাশ করেন, দ্রুত সকল আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এই রায় কার্যকর করা হবে। ফাইয়াজ বলেন, “আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। এখন শুধু চাই দ্রুত কার্যকর হোক।” বরকত উল্লাহ বলেন, “যাতে আর কোনো বাবা তার ছেলেকে হারাতে না হয়, এই রায়ের বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।”
আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও পানি নীতিকে কেন্দ্র করে একটি সমালোচনামূলক স্ট্যাটাস দেন আবরার। ওই রাতেই বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নেওয়া হয় তাঁকে, যেখানে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতাকর্মীরা তাকে ধারাবাহিকভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। দীর্ঘ প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে চলা এই নির্যাতনে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর রাত তিনটার দিকে সিঁড়িতে ফেলে রাখা হয় তার নিথর দেহ। পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে।
এই ঘটনার পরদিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় আবরারের বাবা একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্তের দায়িত্ব পায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মাত্র ৩৭ দিনের মাথায় তদন্ত শেষ করে ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ মামলার রায় দেন বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান। রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
আসামিদের তালিকা
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন:
মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার (অপু), মেহেদী হাসান রবিন (শান্ত), ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, মো. মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, খন্দকার তাবাকারুল ইসলাম (তানভির), হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মো. শামীম বিল্লাহ, মো. সাদাত এ এস এম নাজমুস সাদাত, মুনতাসির আল জেমী, মো. মিজানুর রহমান মিজান, এস এম মাহমুদ সেতু, সামসুল আরেফিন রাফাত, মো. মোর্শেদ (অমর্ত্য ইসলাম), এহতেশামুল রাব্বি (তানিম), মো. মোর্শেদ উজ্জামান মণ্ডল (জিসান) এবং মুজতবা রাফিদ।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন:
অমিত সাহা, ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না, মো. আকাশ হোসেন, মুহতাসিম ফুয়াদ এবং মো. মোয়াজ (মোয়াজ আবু হোরায়রা)।
ডেথ রেফারেন্স ও আপিল প্রক্রিয়া
২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে তা হাইকোর্টের অনুমোদন ছাড়া কার্যকর করা যায় না। এ প্রেক্ষিতে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) ঘোষণা করা হয়। ১৬ মার্চ হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করে এবং ৩ মে এর পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায়।
কারা পালিয়ে আছে, পরিবার কী বলছে?
একাধিক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এখনো পলাতক রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এই বিষয়ে আবরারের পরিবার বেশি কিছু জানে না বলে জানিয়েছে। বরকত উল্লাহ বলেন, “জেল থেকে কেউ পালিয়ে গেছে কি না, সেটা জেল কর্তৃপক্ষের বিষয়। আমরা ছয় মাস পর শুনে অবাক হয়েছি।”
রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য
রাষ্ট্রপক্ষ মনে করছে, এই রায় দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বহুগুণে বাড়াবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আইন অনুযায়ী সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দ্রুত রায় কার্যকর করার প্রস্তুতি নেওয়া হবে।”
এই রায় একদিকে যেমন আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পন্ন করল, তেমনি ছাত্ররাজনীতির নামে সহপাঠীদের হত্যা করার মতো বর্বরতার বিরুদ্ধে এক কঠোর বার্তা হিসেবেও চিহ্নিত হলো। আবরার ফাহাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গোটা জাতি যেভাবে শোকাহত হয়েছিল, আজকের রায়ে তারা খানিকটা হলেও সান্ত্বনা পেল। এখন শুধু অপেক্ষা, দোষীদের সাজা কার্যকর হওয়ার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ