
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকায় বর্ষা মৌসুম মানেই জনদুর্ভোগ, যানজট ও জলাবদ্ধতার ভয়াবহ চিত্র। বর্ষা এখনও শুরু হয়নি, অথচ সাম্প্রতিক কয়েক দিনের হালকা বৃষ্টিতেই ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে। এমন অবস্থায় নগরবাসীর আশঙ্কা— মূল বর্ষা মৌসুমে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও জলাবদ্ধতা নিরসনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং বছর বছর বাড়ছে ভোগান্তি, ক্ষোভ আর হতাশা।
জলাবদ্ধতায় হাঁসফাঁস ঢাকাবাসী
শুধু দুই-একদিনের বৃষ্টিতে নয়, টানা এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে রাজধানীর বহু এলাকা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তথ্যমতে, অন্তত ৩০টিরও বেশি এলাকা জলাবদ্ধতা হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত। এসব এলাকায় প্রতি বর্ষায় নিত্যদিনের মতো ঘটছে জলাবদ্ধতা।
রোকেয়া সরণির বাসিন্দা সালেহা বেগম বলেন, “বৃষ্টির পানিতে এমন অবস্থা হয়, বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা পাওয়া যায় না। কোমর সমান পানি পার হয়ে কাজে যেতে হয়। বাচ্চাদের স্কুল ছুটি দিতে হয়, অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে নিতে পারি না। শহরে থেকে এই কষ্ট মানা যায়?”
মুগদা হাসপাতালের পাশে বসবাসরত আব্দুল কাদের বললেন, “বছরের পর বছর ধরে দেখছি, নর্দমা ও ড্রেনের পানি উপচে রাস্তা পর্যন্ত উঠে আসে। অনেক সময় তো পয়ঃনিষ্কাশনের পানি পর্যন্ত বাসায় ঢুকে পড়ে। অথচ কত প্রকল্প, কত কোটি টাকার বাজেট!”
দুই সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন যৌথভাবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে জলাবদ্ধতা নিরসনে। কিন্তু বাস্তবে সুফল তো দূরে থাক, পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। প্রতিটি প্রকল্পে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং প্রকৃত বাস্তবায়ন জরুরি। বর্ষায় ডুবে গেলে কেউ আর কাউকে দায় দিয়ে পার পাওয়া উচিত হবে না। দায় এখন সিটি কর্পোরেশনের।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি সম্পদ গবেষক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, “প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু জলাধারগুলো পুনরুদ্ধার, খাল খনন, অবৈধ দখলমুক্ত করা— এসব মৌলিক কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না। জলাবদ্ধতা শুধু ড্রেন বা পাম্প দিয়ে সমাধান করা যাবে না, জলাধার পুনরুদ্ধার ছাড়া টেকসই সমাধান অসম্ভব।”
কাজের নামে কাগুজে প্রকল্প, বাস্তবে বিপর্যয়
ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বে থাকা ড্রেনেজ ব্যবস্থার দায়িত্ব ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে সিটি কর্পোরেশনগুলোর হাতে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু এরপরও দায়িত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান একে অপরকে দোষারোপ করে যাচ্ছেই।
সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “ঢাকায় প্রকল্প নেই, তা নয়— সমস্যা হলো বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ে। অর্থ বরাদ্দের চেয়ে বেশি দরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের জবাবদিহিতা। না হলে বর্ষা এলেই আবার মানুষ ডুবে যাবে, আবার মিডিয়া রিপোর্ট করবে, আবার সবাই চুপ।”
প্রশাসনের ভাষ্য: খাল উদ্ধার হচ্ছে, কাজ হচ্ছে
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, “আমরা খাল উদ্ধারে অভিযান শুরু করেছি। কাটাসুর খালের ওপর দোতলা অবৈধ ভবন সম্পূর্ণ এবং তিনতলা ভবনের আংশিক ভেঙে দিয়েছি। ডিএনসিসির কবরস্থানের দেয়ালও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এসব জায়গা থেকে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো হচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১৯টি খাল খননের প্রকল্প বাস্তবায়ন করব।”
তিনি আরও বলেন, “যারা এখনও খাল-বিল দখল করে ঘুমাচ্ছেন, তাদের সময় শেষ। সরকারি জমি দখল করে কেউ রেহাই পাবে না। দখলমুক্ত করেই ঢাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করব।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। খাল ও ড্রেন পরিষ্কারকরণ কর্মসূচি চলছে। তবে বর্ষাকালের কাজ খুবই চ্যালেঞ্জিং। প্রকল্পের অগ্রগতি সময়সাপেক্ষ। আমাদের কিছু প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেতে পারেনি।”
জলাবদ্ধতার প্রকৃত কারণ কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য তিনটি উপায় রয়েছে— পাম্প, স্লুইসগেট ও খাল। এর মধ্যে বহু পাম্পস্টেশন এবং স্লুইসগেট বর্তমানে অকেজো। খালগুলোও দখল-দূষণে বন্ধ।
প্রতিদিন ঢাকা শহরে প্রায় ৭ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ১৫% হলো প্লাস্টিক বর্জ্য। এর বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত ড্রেন ও খালেই গিয়ে পড়ে। খালগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার না হওয়ার কারণে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয় এবং সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
নগরবাসীর হতাশা, ভবিষ্যতের শঙ্কা
ঢাকা কলেজের ছাত্র রাজীব হাসান বলেন, “প্রতিবার ভোটের সময় বলে জলাবদ্ধতা থাকবে না। কিন্তু পাঁচ বছর পরেও সেই একই কাহিনি। খাল নিয়ে নাটক, পরিষ্কার দেখানো যায় না— অথচ টাকা গেল কোথায়?”
ধানমন্ডির ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, “কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই দোকানে পানি উঠে পড়ে। মালপত্র নষ্ট হয়। ক্ষতি কেউ পোষায় না, কর তো ঠিকই নিচ্ছে সরকার!”
সময় এখন সত্যিকারের উদ্যোগের
পর্যবেক্ষকদের মতে, ঢাকায় জলাবদ্ধতা রোধ করতে হলে কেবল টাকা খরচ নয়, দরকার জবাবদিহিতামূলক বাস্তবায়ন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা। নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানো, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খাল ও ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কারের সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
নগর বিশেষজ্ঞ আ ক ম শরীফুল ইসলাম বলেন, “ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, বরং এটি একটি টেকনিক্যাল ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা। সমন্বিত পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সমাধান হবে না।”
বর্ষা তো আসবেই। কিন্তু রাজধানী কি আরেকবার জলে ডুবে কাঁদবে? নাকি এবার সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন ঘটবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ