
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষার মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে এবার সরাসরি ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম ও মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সরকার। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারলে এসব কলেজের ওপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। সেই পদক্ষেপের শেষ ধাপে রয়েছে কলেজ বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনাও। যদিও এখনও কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর দুর্বলতা ও অদক্ষতার বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সরকারি সূত্র বলছে, মানহীন চিকিৎসক তৈরি হলে তার মূল্য দিতে হয় গোটা জাতিকে। তাই কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, সংকটে ৬টি
বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ১১০টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে, যার মধ্যে সরকারি কলেজ ৩৭টি। এসব কলেজের মধ্যে নেত্রকোনা, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, মাগুরা ও নীলফামারী মেডিকেল কলেজ নিয়ে সরকার গভীরভাবে চিন্তিত। এসব কলেজে নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো, নেই স্থায়ী ক্যাম্পাস, শিক্ষকের পদ অধিকাংশই খালি, ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরির ঘাটতি প্রকট, আবাসন সংকটও মারাত্মক। এতে করে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা কার্যক্রম কার্যত ব্যাহত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এসব কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মূলত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, মানবসম্পদ, এবং প্রশাসনিক পরিকল্পনা ছাড়াই চালু করা হয় মেডিকেল শিক্ষার মতো জটিল ও দায়িত্বপূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে নামেই মেডিকেল কলেজ হলেও সেখানে আদর্শ চিকিৎসক তৈরি হওয়ার পরিবেশ নেই। নতুন সরকার এসব কলেজ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে এবং কোনো ধরনের মানহীনতা সহ্য না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নেত্রকোনায় ৮৪ পদের ৩৪টি খালি, অধ্যাপক মাত্র একজন
নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজের অবস্থা চিত্র তুলে ধরলে দেখা যায়, কলেজটিতে মোট অনুমোদিত শিক্ষকের পদ ৮৪টি হলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৫০ জন। অধ্যাপকের ১২টি পদের মধ্যে ১১টিই শূন্য, শুধু অধ্যক্ষ পদটি পূর্ণ। শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ভাড়া করা বহুতল ভবনে, যেখানে শ্রেণিকক্ষ ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য ত্রুটিপূর্ণ স্থানেই চলছে পাঠদান।
তবে কিছু ইতিবাচক খবরও রয়েছে। নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি থেকে ৫০ একর জায়গা মেডিকেল কলেজকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে ফাইলটি ভূমি মন্ত্রণালয়ে আছে নামজারির অপেক্ষায়। একবার নামজারি হয়ে গেলে নতুন করে অধিগ্রহণ প্রয়োজন হবে না। স্থানীয় প্রশাসনও সক্রিয়ভাবে কাজ করছে অবকাঠামোগত উন্নয়নে।
চাঁদপুরে চলছে হাসপাতালের ওয়ার্ডে মেডিকেল কলেজ
চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজ ২০১৯ সালে মাত্র ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে সেখানে ৪০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। কিন্তু কলেজের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। কার্যক্রম চলছে চাঁদপুর সদর জেনারেল হাসপাতালের ছোট ছোট ১১টি কক্ষে, যা মূলত কেবিন ও ওয়ার্ডের অংশ। এমন অবস্থায় প্রয়োজনীয় ল্যাব, লাইব্রেরি, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকসংখ্যা নিশ্চিত করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে ৫৫ জন শিক্ষক থাকলেও ২৩টি পদ শূন্য। মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মো. হারুন অর রশিদ বলেছেন, “ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। আশা করছি ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো কেটে যাবে। এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বন্ধের গুজব ভিত্তিহীন।”
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিনও একই কথা বলেছেন, “জমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে। কোনো বন্ধের নির্দেশনা আমাদের হাতে আসেনি।”
হবিগঞ্জে নেই স্থায়ী ক্যাম্পাস, চিকিৎসা হচ্ছে পাশেই
হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজে ৫১ জন শিক্ষক রয়েছেন। ক্লাসরুমের জায়গা প্রায় ২৮ হাজার বর্গফুট। কলেজটি কার্যত হাসপাতালের ওপর নির্ভর করেই চলছে। কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাবেদ জিল্লুল বারী বলেন, “আমাদের প্রধান সমস্যা স্থায়ী ক্যাম্পাসের অভাব। সরকার চাইলে বর্তমান হাসপাতাল প্রাঙ্গণেই স্থায়ী ভবন গড়ে তুলতে পারে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই কমবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে রোগী দেখার সুযোগ পাচ্ছে, এটি বড় একটি সুবিধা। অনেক মেডিকেল কলেজে এমন সুযোগ নেই।”
নওগাঁ, নীলফামারী ও মাগুরা মেডিকেল: অবস্থা জটিল হলেও কিছু উন্নয়ন চোখে পড়ছে
নওগাঁ মেডিকেল কলেজ চলছে জেলার ২৫০ শয্যার হাসপাতালের পুরোনো ভবনের দ্বিতীয় তলায়। শিক্ষার্থী প্রায় ৩২০ জন, অথচ প্রয়োজনীয় লেকচার হল আছে মাত্র চারটি।
নীলফামারী মেডিকেল কলেজে কার্যক্রম চলছে ম্যাটসের পুরোনো ভবনে, কারণ ম্যাটস কার্যক্রম বর্তমানে নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের ৩৫ একর জমিতে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
মাগুরা মেডিকেল কলেজের অবস্থা তুলনামূলকভাবে কিছুটা উন্নত। পুরোনো হাসপাতাল ভবনে শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, শিক্ষকদের রুম ও লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়েছে। আবাসনের ব্যবস্থাও আংশিক নিশ্চিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের স্পষ্ট বার্তা: মানহীন শিক্ষা চলবে না
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন স্পষ্ট করে বলেন, “সরকারি হোক বা বেসরকারি—মেডিকেল শিক্ষায় মান নিশ্চিত করতেই হবে। এটি কোনো আপসের জায়গা নয়। আমরা চেষ্টা করব এসব কলেজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে। প্রথমে মানোন্নয়ন, এরপর ক্যাপাসিটি কমিয়ে আনা হবে। তাতেও না হলে শেষ অপশন হিসেবে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে আমাদের লক্ষ্য বন্ধ না করে উন্নয়ন করা।”
তিনি বলেন, “যেসব কলেজে ৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন, সেখানে ৫০ জনে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হতে পারে। কিন্তু সেটিও হবে পরিস্থিতি অনুযায়ী।”
রাজনৈতিক প্রভাব ও সামাজিক চাপ
জানা গেছে, কলেজগুলো বন্ধ হওয়ার গুঞ্জনের পর শিক্ষকদের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিক এবং প্রভাবশালীরা সক্রিয় হয়েছেন। তারা কলেজ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। বিভিন্ন জেলায় দেখা গেছে মানববন্ধন, স্মারকলিপি, এমনকি ঢাকায় দৌড়ঝাঁপও। কারণ এসব কলেজ স্থানীয় জনগণের প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
শিক্ষা মানে জীবন, আপস নয়
বাংলাদেশে চিকিৎসা শিক্ষা শুধু একজন শিক্ষার্থীর পেশাগত গঠন নয়, বরং মানুষের জীবন-মরণ সমস্যার সরাসরি সঙ্গে জড়িত। মানহীন শিক্ষা থেকে বের হওয়া চিকিৎসকের হাতে যখন একজন রোগী পড়ে, তখন সেটি হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকি। তাই সরকার যে এবার মেডিকেল শিক্ষার মান নিয়ে কঠোর অবস্থানে গেছে, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং ন্যায্য। তবে এটিকে শুধু ‘বন্ধ করার হুমকি’ হিসেবে না দেখে, ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ