
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত, যেটি দেশের অর্থনীতি ও উন্নতির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত, সেখানে ব্যাপক দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের মূল দায়িত্বে থাকা পাঁচ ব্যক্তি, যাদের “পঞ্চপাণ্ডব” বলা হয়, তাঁরা দেশের বিদ্যুৎ খাতের নানা স্তরের সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে ছিল সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, সাবেক এসডিজি বিষয়ক সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, সামিট গ্রুপের প্রধান আজিজ খান এবং এস আলম গ্রুপের কর্ণধার। এই পাঁচজনই ছিলেন বিদ্যুৎ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেনের মূল নিয়ন্ত্রক।
তারা বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ, পদায়ন এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন। তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল দেশের বিদ্যুৎ খাত, এবং এই খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই ছিল তাদের লুটপাটের নীতি অনুসারে। তথ্য অনুসারে, এই পঞ্চপাণ্ডবের অধীনে বিদ্যুৎ খাতে জন্য বেশ কিছু বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এগুলো মূলত তাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্যই ছিল।
পঞ্চপাণ্ডবের গডফাদারদের কমিশন প্রদান করা হচ্ছিল, যা তাদের অপরাধকে এক প্রকার বৈধতা দিয়েছিল। এই গডফাদাররা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। তারা সরকারী অর্থের এই বিশাল লুটপাটের মূল হোতা ছিলেন, এবং তাদের স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্বের ফলে বিদ্যুৎ খাতের দুনীতির পরিমাণ বেড়ে যায়।
কুইক রেন্টাল দুর্নীতি:
একটি বড় দুর্নীতি ছিল কুইক রেন্টাল ব্যবস্থাপনা, যার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই সরকারকে “ক্যাপাসিটি চার্জ” প্রদান করতে বাধ্য করা হতো। কুইক রেন্টাল সিস্টেমের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো ভূমিকা না রেখে, বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি খাতের মালিকরা বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিতেন। তবে, সরকারের কোনো কার্যকরী চেক এবং ব্যালেন্স ব্যবস্থা না থাকায়, এই সব অপকর্ম আর্থিকভাবে অত্যন্ত লাভজনক হয়ে উঠেছিল।
এভাবেই, সরকারের খরচ বেড়ে যায়, কিন্তু দেশের জনগণের বিদ্যুৎ সরবরাহের মান বা পরিমাণ তেমন বাড়ে না। তথ্যে জানা গেছে, শুধুমাত্র কুইক রেন্টাল প্রকল্পে প্রায় ১৫ বছরে সরকারের খরচ হয়েছিল প্রায় দুই হাজার ৮৩০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের একটি বড় অংশ ছিল ক্যাপাসিটি চার্জ নামে লুটপাট।
বৈদেশিক অর্থনীতির বিশ্লেষক ড. আনিসুর রহমান মন্তব্য করেন, "কুইক রেন্টাল প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন না করেই বিশাল ক্যাপাসিটি চার্জ নেয়া ছিল সরকারের জন্য একেবারে আত্মহত্যার মত সিদ্ধান্ত। এর ফলে জনগণের বিদ্যুৎ বিল বাড়ে, অথচ বিদ্যুৎ উৎপাদন বা সরবরাহের কোনো অগ্রগতি হয় না।"
ভারতনির্ভরতা এবং বিদ্যুৎ আমদানির দুর্নীতি:
বিদ্যুৎ খাতে ভারতনির্ভরতার বৃদ্ধিও পঞ্চপাণ্ডবের দুর্নীতির আরেকটি বড় অংশ। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হলেও, এতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার মাধ্যমে আবারও অর্থ লুণ্ঠন করা হয়েছে। ভারতের আদানি এবং রিলায়েন্স কোম্পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়, যেখানে পঞ্চপাণ্ডবের গডফাদাররা কমিশন পেতেন। ফলস্বরূপ, দেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের বদলে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে শোষণ চালানো হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ফজলুল হক বলেছেন, "বিদ্যুৎ আমদানির নামে দেশের অর্থনীতি থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে গেছে, তা অন্যায়। পঞ্চপাণ্ডবের এমন সিদ্ধান্ত শুধু তাদের ব্যক্তিগত লাভই বাড়িয়েছে, বরং বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বড় দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে দুর্নীতি:
বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। মিটার কেনাকাটা, বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের নামেও অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি হয়েছে। প্রমাণ রয়েছে যে, গ্যাসক্ষেত্রে কূপ খননের নামে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রকল্পের ব্যয় ছিল অত্যধিক।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক আর্থিক উপদেষ্টা ড. মাহমুদ হাসান বলেন, "বিদ্যুৎ খাতে যে বিশাল অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হয়েছে এবং এ কারণে জনগণের পকেট থেকে যে অর্থ চলে গেছে, তা দেশের জন্য এক বড় বিপর্যয়।"
এছাড়া, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ প্রকল্পে ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা এবং আর্থিক দুর্নীতি ছিল। ৫০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে, যেখানে সরকারী খরচ ছিল অত্যধিক। এই দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবার, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং তার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক।
আইন বিশেষজ্ঞ তানভীর আহমেদ মন্তব্য করেন, "রূপপুর প্রকল্পে যে সমস্ত অস্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন হয়েছে, তা কোনভাবেই অনুমোদিত হতে পারে না। এর মাধ্যমে দেশের আইনের প্রতি জনগণের আস্থা কমে গেছে।"
আইন ও নীতির অবমাননা:
এই দুর্নীতির মধ্যে আইন এবং নীতির কোনো পরিপালন ছিল না। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে নৈতিকতার কোনো মানদণ্ড ছিল না, এবং তারা দুর্নীতি করার জন্য সরকারের দুর্বলতা এবং আইনের শূন্যস্থান কাজে লাগিয়েছিল। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এবং বিদ্যুৎ খাতের শীর্ষ ব্যক্তিরা নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য এই ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা দেশের জনগণের জন্য একটি বড় আঘাত।
প্রেস ক্লাবের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, "আইন ও নীতির অবমাননা করা হলেও সরকারের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সাধারণ মানুষের স্বার্থ নিয়ে এই ধরনের দুর্নীতি চালানো দেশের উন্নয়নকে পিছিয়ে দিয়েছে।"
সরকারের নীরবতা:
এই বিশাল দুর্নীতির ঘটনার বিরুদ্ধে সরকারী নীরবতা ছিল আশ্চর্যজনক। যতদিন না ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়নি, ততদিন পর্যন্ত এই সকল দুর্নীতি ও লুটপাটের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবশেষে, এই সব তথ্য জনসমক্ষে আসার পর বিভিন্ন অঙ্গন থেকে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেন, "সরকার যদি শৃঙ্খলাপূর্ণভাবে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিত, তবে দেশের ভবিষ্যত আরও অন্ধকার হতে পারতো। এই সময়েই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।"
বিদ্যুৎ খাতে পঞ্চপাণ্ডবের অত্যাচার এবং তাদের দুর্নীতি দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য এক বিশাল ক্ষতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুর্নীতি শুধু দেশীয় অর্থনীতি এবং জনগণের উপকারে কোনো অবদান রাখেনি, বরং এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। সঠিক তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এই দুর্নীতি মোকাবেলা করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে দেশের বিদ্যুৎ খাতে শুদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ